
চলতি বছরের ৯ জুলাই (বুধবার) বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি ভয়াবহ ও লজ্জার দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই সন্ধ্যায়, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে ব্যস্ত সড়কে, শত শত মানুষের সামনে একজন নিরস্ত্র মানুষকে পাশবিক আর বুনো উল্লাসে থেঁতলে হত্যা করা হয়। নিহতের নাম লাল চাঁদ সোহাগ-একজন বাংলাদেশি, একজন ব্যবসায়ী, একজন মানুষ, যার শরীর থেকে আত্মাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। তাকে সড়কে ফেলে ইট-সিমেন্টের ব্লকের আঘাত ও লোহার রডের নৃশংস তাণ্ডব দেখিয়েছে একদল নরপিশাচ।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়-কয়েকজন ব্যক্তি রাস্তায় ফেলে দেয়া সোহাগের নিথর দেহের ওপর উম্মাদের মতো লাফাচ্ছেন। কারও হাতে ইট, কারও হাতে সিমেন্টের ভারী ব্লক, কারও হাতে লোহার রড। একজন আঘাত করছে মাথায়, আরেকজন হাঁটু দিয়ে পাঁজর চেপে ধরে আছে, কেউ আবার হিংস্র উল্লাসে বলে উঠছে- মেরে শেষ করে দে!
এটা শুধু নরহত্যা ছিল না-এটা ছিল বিকৃত উল্লাসে মানবিক বিপর্যয় উদযাপনের মহোৎসব। যেন সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া মুহূর্তের মধ্যে থমকে গিয়েছিল সময়ের কোনো অন্ধকার গহ্বরে, যেন চারশত বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহর আর এর একটি জনবহুল ঝলমলে সড়ক হঠাৎ মধ্যযুগের বর্বরোচিত কোনো এক পথ হয়ে উঠেছিল।
সোহাগের বুকের পাঁজর ভাঙার শব্দ যেন গোটা সমাজের পতনের আর্তনাদ। কারণ হত্যাকারীরা আমাদের সমাজেরই কেউ না কেউ। কোন না কোন বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান তারা, কারও ভাই, কারও ভাগ্নে, কারও ভাইপো। ভিডিও দেখে অনেকে অনুমান করেছেন, হামলাকারীদের আঘাতে সোহাগের বুকের পাঁজরগুলো কটমট করে ভেঙে গিয়েছিল। এই শব্দ শুধু হাড় ভাঙার ছিল না, এটি যেন জাতির মানবিকতা, ন্যায়বিচার ও নৈতিকতা এক এক করে ভেঙে পড়ার করুণ আওয়াজ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সূত্রে বলা যায়, তার থেঁতলে যাওয়া শরীরে যে পরিমাণ ‘ব্লান্ট ট্রমা’ ছিল, তা শুধু মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট নয়, বরং মৃত্যুর আগে অসহনীয় যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ভিডিওর এক মর্মান্তিক মুহূর্তে, পৈশাচিকতার মাঝেই রক্তাক্ত সোহাগ হঠাৎ কাতরভাবে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। তার ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু বুনো উল্লাসের মাঝে তার শব্দ হারিয়ে যায়। সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও দেখে অনেকের ধারণা জন্মেছিল, তিনি হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, ‘বাঁচাও’ অথবা ‘আমি কিছু করিনি।’ তবে সেখানে উপস্থিত কেউ এগিয়ে যাননি। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ছিল নিরব দর্শক, কেউ মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করছে-কিন্তু কেউ ছুটে আসেনি, হয়তো প্রাণভয়ে। তাই এটি শুধু একজন মানুষের মৃত্যু ছিল না-এটি ছিল একটি দ্বিধাগ্রস্ত এবং কুলষিত সমাজের সম্মিলিত আত্মসমর্পণ।
পুলিশ জানিয়েছে এ ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১৯ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মূল দল বিএনপির পক্ষ থেকে চারজনকে তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়-এই হিংস্রতা, বর্বরতা ও বিকৃত উন্মাদনা কীভাবে জন্ম নেয়? কারা এদের তৈরি করছে, প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিচ্ছে?
কেন এই হত্যাকাণ্ড মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়: মধ্যযুগে অপরাধীর শাস্তি হিসেবে জনসমক্ষে ভয়াবহ অত্যাচার, হাত-পা কেটে ফেলার নজির আছে। কিন্তু সোহাগ তো কোনো শত্রু সেনা, রাজদ্রোহী কিংবা অপরাধী নন। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, একজন সাধারণ নাগরিক। তার অপরাধের প্রমাণ কোথাও নেই, তার অপরাধের দায় কোথাও ওঠে আসেনি। তবু তার উপর নেমে এলো এমন নির্মমতা-যা পাশবিকতা নয়, বরং মনুষ্যত্বহীনতার এক কলঙ্কিত নিদর্শন, যা মধ্যযুগের ‘শাস্তিমূলক বর্বরতার’ চেয়েও ঘৃণ্য, কারণ এখানে ন্যায়-বিচারের মুখোশও পরা হয়নি, বরং আক্রমণ চালানো হয়েছে সরাসরি উন্মাদনার ক্ষোভে।
সোহাগ হত্যার ভিডিও ফুটেজ যতবার দেখা হচ্ছে, ততবার নতুন করে প্রশ্ন জাগছে-আমাদের মাঝে কি এখনো মনুষ্যত্ব জেগে আছে? নাকি প্রতিপক্ষ দেখলেই বিভৎস আক্রমণের পশু-সত্তা জেগে ওঠে?
যে সমাজে একজন নিরীহ মানুষকে পিষে-থেঁতলে জনসমক্ষে হত্যার সময় কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসে না, সে সমাজ কি কোনো সভ্যতার দাবিদার হতে পারে? ভয়াল নির্মমতার শিকার সোহাগ এই প্রজন্মের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু তার রক্তের ছাপ, না বলা ফিসফিস শব্দ মিশে গেছে আকাশে-বাতাসে। রয়ে যাবে আমাদের শহরের রাস্তায়, কিছু বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে, বিবেকে। তার না-বলা শেষ কথা হয়তো একটাই ছিল-‘কেউ কি আছো মানুষ হয়ে দাঁড়াও-এরকম মৃত্যু যেন আর কারও না হয়…’ আমরা কি শুনছি সেই অস্পষ্ট ভাষাটি? নাকি এটাও হারিয়ে যাবে পরবর্তী হত্যার অপেক্ষায় থাকা এক নীরব সমাজের মাঝে?
অনেকের মতে, এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। যদি একজন মানুষ জনসমক্ষে এমনভাবে হত্যার শিকার হন আর রাষ্ট্র-সমাজ নীরব থাকে, তবে আমরা কার কাছে ন্যায় বিচার চাইবো?
এই বর্বরতা দেখে মনে হয়েছে আমরা যেন এখন আর কোনো সভ্য সমাজে বাস করছি না। সোহাগের চোখে শেষ মুহূর্তে যা ছিল, তা ছিল তার নিজের জীবন নয়, মানবতা বাঁচানোর আর্তি।
ভিডিও দেখে কেউ কেউ জানিয়েছেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এটি সিনেমার দৃশ্য নয়-এটি বাস্তব! আমাদের ঢাকা শহর। আমরা কি শুধুই দর্শক হয়ে থাকবো। এই ধরনের নৃশংসতা দেখে মনের গভীর থেকে শুধু একটি শব্দ উঠে আসে। আর তা হলো জাতীয় লজ্জা। তরুণ প্রজন্মের সামনে কী উদাহরণ তৈরি করছি আমরা?
কেউ কেউ বলেন, এই ঘটনাটি গোটা জাতিসত্তার ওপর এক নির্মম আঘাত। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও নাগরিক সমাজ-সবাইকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। না হলে এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।
এই হত্যাকাণ্ড একটি মুহূর্তের ঘটনা নয়-এটি একটি চেতনার মৃত্যু, মানবতার অবমাননা। জনমনের এমন প্রতিক্রিয়াগুলো আমাদের কেবল বাকরুদ্ধ করে না, অদ্ভুতভাবে জাগিয়েও তোলে। প্রশ্ন একটাই, আমাদের নীরবতার কারণে আর কত সোহাগকে এমন নির্মমতার শিকার হতে হবে?
সোহাগের মৃত্যুর মুহূর্ত ও যন্ত্রণার তীব্রতা নিয়ে অনেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, ভিডিওটি দেখে অনুমান করা যায়, তার পাঁজরের অনেকগুলো হাড় ভেঙে গেছে। লোহার রড ও সিমেন্টের ব্লকের আঘাতে তার অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একসঙ্গে এত যন্ত্রণা সহ্য করা কোনও জীবন্ত মানুষের পক্ষে কল্পনাতীত। তিনি নিঃশ্বাস নিতেও পারছিলেন না। এ ছিল একধরনের শ্বাসরোধী মৃত্যু, যেখানে মৃত্যুর আগে তীব্র যন্ত্রণায় আত্মা হেরে যায়।
যে মুহূর্তে সোহাগ ব্যথায় ছটফট করছিলেন, চারপাশে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছিল-কেউ চিৎকার করেনি, কেউ দৌড়ে আসেনি, সেই ভয়ার্ত সময়ের প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেন, আমরা কী নীরব দর্শক হয়ে উঠেছি? তার হাহাকার ছিল পুরো জাতির কাছে এক অজানা চিৎকার- ‘আমি মানুষ, আমাকে মেরো না!’
যে যন্ত্রণায় সোহাগের দেহ কাঁপছিল, তা শুধু শারীরিক যন্ত্রণা ছিল না, বরং ছিল রাষ্ট্রীয় অবহেলা, নাগরিক নিষ্ক্রিয়তা ও গণ-নৈরাজ্যের প্রতিচ্ছবি। শেষ মুহূর্তে হয়তো তিনি চেয়েছিলেন একটি হৃদয়বানের দৃষ্টি-যেখানে করুণা থাকে যা বাঁচার শেষ আশা জাগিয়ে তোলে। কিন্তু অনেকে আমরা সেখানে তাকিয়ে ছিলাম ফোনের ক্যামেরায়।
কেউ কেউ বলেন, একজন মানুষ যখন থেঁতলে যাওয়া শরীর নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস খুঁজছিলেন, তখন তার চারপাশের সমাজ ছিল নির্বিকার। সোহাগের শেষ মুহূর্তগুলো আমাদের শিক্ষা দেয়-মানবিকতা ছাড়া উন্নয়ন মানে মৃত্যু। পাঁজর ভাঙার তীব্র যন্ত্রণার কাছে সোহাগ শুধু একাই হেরে যায়নি আমরাও হেরে গেছি, জাতির বিবেকও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।