
সম্প্রতি কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকত এলাকায় গোসলে নেমে সাগরের স্রোতে ভেসে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের তিন শিক্ষার্থী—অরিত্র হাসান, কে এম সাদমান রহমান ও আসিফ আহমেদ। পরে সাদমান ও আসিফের মরদেহ উদ্ধার করা গেলেও অরিত্র হাসানকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ শনিবার (১২ জুলাই) সকাল থেকে বিমান বাহিনী ড্রোন উড়িয়ে কক্সবাজার উপকূলে তার অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
তবে শুধু এই ঘটনাই নয়, চলতি বছরের এপ্রিলের শেষদিক থেকে জুলাই পর্যন্ত দুই মাসের কিছু বেশি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২১ শিক্ষার্থীর আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৫ জন, শারীরিক জটিলতায় মারা গেছেন ৩ জন এবং বাকি ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও হত্যাকাণ্ডে।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ১৪ মে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পাশে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্যের মৃত্যু। এ ছাড়াও আলোচিত হয় ঢাকার বনানীতে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গত ১৯ এপ্রিল টেক্সটাইল বিভাগের শিক্ষার্থী পারভেজকে ছুরি মেরে হত্যার ঘটনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা অনেক সময় তাদের ভেতরে জমে থাকা হতাশা বা মানসিক চাপ কারও সঙ্গে ভাগ করতে পারেন না। ফলে একাকীত্ব, বিষণ্ণতা বা দিশাহীনতার কারণে তারা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিবার, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আরও সংবেদনশীল ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে—বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা এবং নিরাপদ, সহানুভূতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে।
দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১০ জন
গত ৮ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থী হিমছড়ি সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে নেমে প্রাণ হারান কে এম সাদমান রহমান ও আসিফ আহমেদ নামে দুইজন। তবে অরিত্র হাসানকে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গত ১১ জুন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহরিয়ার নিহাল নামের এক শিক্ষার্থী নদীতে গোসল করতে নেমে মারা যান। এর আগে গত ৬ মে পুকুরে গোসল করতে নেমে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শান্তনু কর্মকার মারা যান। এদিকে, গত ১ মে বজ্রপাতে মারা যান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান খান রাফি এবং ২৮ মে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. জিহাদ।
১ জুন মোটরসাইকেল বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের দশম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাগর শেখ মারা গেছেন। ১৩ জুন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন এবং ১৬ জুন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম মারা যান।
আত্মহত্যা ৫ জনের
স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার দুই দিন পর ‘আত্মহত্যা’ করেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ তারেক ওয়াদুদ নাহিদ। শুক্রবার (১১ জুলাই) দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর মিরপুর-১ এলাকার ভাড়া বাসায় নিজ কক্ষে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ পাওয়া যায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম ব্যাচের টেক্সটাইল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। নিহত নাহিদের বাড়ি রাজশাহী জেলার বাগমারা উপজেলার রক্ষিতপাড়ায়। তিনি এ কে এম আব্দুল ওয়াহেদের ছেলে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জান্নাতুল ফেরদৌসি টুম্পা নামে এক ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে গত ১ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান ধ্রুবর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয় রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে।
১১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ (২৪) আত্মহত্যা করেছেন বলে জানায় তার পরিবার। গত ৬ মে শিহাবুল ইসলাম (২৪) নামে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩ জন
গত বুধবার (৯ জুলাই) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার টিউবারকুলোসিসে (টিবি) আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর একদিন আগে ৮ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান খান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। গত ২২ জুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোবায়ের হোসাইন হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
হত্যাকাণ্ড ৩ জন
১৪ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চের পাশে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য মৃত্যুবরণ করেন। তিনি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। তিনি এই হলের ২২২ নম্বর কক্ষে থাকতেন।
ঢাকার বনানীতে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গত ১৯ এপ্রিল টেক্সটাইল বিভাগের শিক্ষার্থী পারভেজকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়।
চারদিন নিখোঁজ থাকার পর ১৯ মে রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকার মেট্রোরেল লাইনের একটি পিলারের পাশ থেকে মাহমুদুল হাসান (২৪) নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে মরদেহ উদ্ধারের পর এটি দুর্ঘটনা, খুন না অন্য কিছু—এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ৫৩তম ব্যাচের (দ্বিতীয় শিফট) শিক্ষার্থী ছিলেন।
আকস্মিক এসব মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় তারা তাদের চেপে রাখা হতাশাগুলো কারও কাছে বলে না। এ বিষয়ে প্রতিটি বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি কাউন্সেলিং সেবা, সহমর্মিতামূলক পরিবেশ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসতে পারে।’