Image description

ছেলেকে বিসিএস ক্যাডার আর মেয়েকে ব্যাংকার বানানোর স্বপ্ন নিয়ে প্রতিদিন ঘাম ঝরিয়ে মুরগির দোকানে বসতেন কোরবান শেখ। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও দমে যাননি, ন্যূনতম চাহিদা পূরণের সংগ্রামে স্ত্রী আর দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে জীবনটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ছোট্ট দোকান আর পরিবার ঘিরেই গড়ে ওঠা স্বপ্ন একটিমাত্র দিনে থেমে গেলো। কারফিউ চলাকালে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারালেন এই স্বপ্নবাজ মানুষটি। প্রাণভিক্ষা চেয়েও শেষরক্ষা হয়নি তার।

রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার পূর্ব রতনদিয়া গ্ৰামের মৃত মেহের শেখের ছেলে কোরবান শেখের বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও জীবনের প্রয়োজনে প্রায় দেড় যুগ আগে স্ত্রী আর ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকায়। সাভারের বাসস্ট্যান্ড এলাকার মাছবাজারে ছোট একটি মুরগির দোকান চালাতেন তিনি। নিজের জীবনের সবটুকু জুড়ে ছিল কেবল দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ। ছেলে রমজান শেখ এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, আর মেয়ে মিতু আক্তার ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ প্রথম বর্ষে পড়ছেন।

সবকিছু ঠিকই চলছিল। অভাব ছিল, কিন্তু স্বপ্নের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু ২০২৪ সালের ২০ জুলাই দিনটি হয়ে ওঠে পরিবারটির জন্য এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। সেদিন সকাল থেকেই রাজধানীজুড়ে চলছিল কারফিউ। তবুও অনেক দোকানির মতো কোরবান শেখও নিজের দোকান খুলেছিলেন সকাল ৯টার দিকে। বাসা থেকে হাঁটাপথে মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের পথ সেই দোকান। দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে এলাকা। তখন কোরবান শেখের মেয়ে মিতু ফোন করে আব্বুকে দ্রুত বাসায় ফিরতে বলেন।

কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় অঘটন। দুপুর ২টার দিকে বাজারের আরেক দোকানি ফোন করে কোরবান শেখের ছেলেকে জানান, তার বাবা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। দৌড়ে গিয়ে তিনি দেখতে পান, আশপাশের দোকানিরা তার বাবাকে কোলে করে নিয়ে আসছেন। প্রথমে এক হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাকে ভর্তি করা হয়নি। পরে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক জানান, তিনি আর বেঁচে নেই।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গোলাগুলির শব্দ শুনে কোরবান শেখ দোকান বন্ধ করে বাসার দিকে ফিরছিলেন। কিন্তু সামনে সংঘর্ষ হতে দেখে তিনি মাছ বাজারের বরফকলের গেট আটকে ভেতরে আশ্রয় নেন অন্য কয়েকজন দোকানির সঙ্গে। সেই আশ্রয়স্থলেও শান্তি ছিল না। দুর্বৃত্তরা বরফকলের গেট ভেঙে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। কোরবান শেখের বুকে ও পায়ে দুটি গুলি লাগে, বুকে ও মুখে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন ছিল। সেখানেই থেমে যায় তার জীবন।

সেদিন রাত ৯টার দিকে তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। রাত ১১টার দিকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় শহীদ কোরবান শেখকে। কিন্তু দাফনের পরও স্তব্ধ হয়ে রয়েছে তার পরিবার। স্ত্রী শিল্পী খাতুন, ছেলে রমজান শেখ আর মেয়ে মিতু আক্তারের চোখে এখন কেবলই বিস্ময়, ব্যথা আর একরাশ শূন্যতা।

মেয়ে মিতু আক্তার বলেন, ‘আমার আব্বুর স্বপ্ন ছিল ভাইয়াকে বিসিএস ক্যাডার আর আমাকে ব্যাংকার বানাবেন। সেই লক্ষ্যেই আমাদের পড়ালেখা করাচ্ছিলেন। তিনি হাঁটতেই পারতেন না। কোনো আন্দোলনেও যাননি। তাকে গুলি করে মারল কেন? তার শরীর দেখলেই কারো মায়া লাগার কথা।’ তার কণ্ঠে ছিল অসহায় আর্তি, ‘আমি সরকারের কাছে বিচার চাই, আমার ও ভাইয়ার চাকরির ব্যবস্থা চাই। আব্বুর স্বপ্ন পূরণ হোক।’

স্ত্রী শিল্পী খাতুন বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। বলছিলেন, ‘আমার স্বামী কোন রাজনীতি করতো না। দোকান বন্ধ করে ফিরছিলেন। তিনি কাঁদছিলেন, হাতজোড় করে পুলিশকে বলছিলেন—‘আমাকে মারেন না।’ তবুও গুলি করল। আমার স্বামীর সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। এখন আমার সন্তানদের কে দেখবে?’

ঘটনার পর কোরবান শেখের ছেলে রমজান শেখ যে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিয়েছেন, সেগুলোর উত্তর নেই কারও কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার আব্বু আন্দোলন করেনি, প্রতিবন্ধী ছিলেন, একজন সাধারণ মানুষ। তাকে কেন মারা হলো? কেন?’