
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করতেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পাশাপাশি তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলাপ করে এমনটি জানা গেছে। নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের কথাও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তার এমন ঘোষণায় জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে এবং নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ-সংশয় দূর হয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহলের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নানা সন্দেহ-অবিশ্বাস জল্পনা-কল্পনা চলছিল গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই। যদিও লন্ডনে গত ১৩ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর কিছুদিনের জন্য জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কিছু দলের বিএনপিবিরোধী তৎপরতায় নির্বাচন নিয়ে সংশয়-সন্দেহ দানা বাঁধে। কারণ এই দলগুলোর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, সংস্কার এবং পিআর পদ্ধতি ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নির্বাচন নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ঘনীভূত হয়। অনেকে এমনও বলছেন যে, সরকার ক্ষমতা ছাড়তে চাইছে না। নানা কৌশলে তারা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইছে। তবে এমন নানা কথাবার্তা এবং গুঞ্জনের মধ্যেই গত বুধবার হঠাৎ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হয়, ‘নির্বাচন সামনে রেখে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে লোকবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও ক্রয়সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ শেষ করতে হবে। এ ছাড়া বিগত তিন বিতর্কিত নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করার বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার এই নির্দেশে দলগুলোর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তার নির্দেশ অত্যন্ত ইতিবাচক বলে দলগুলো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তার নির্দেশ আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সরকার নির্বাচন দেওয়ার পথেই রয়েছে বলে দলগুলো মনে করছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব কাজ গুছিয়ে রাখার জন্য। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার। আমরা আশা করব যে, নির্বাচন কমিশন এই কাজ (নির্বাচনের প্রস্তুতি) খুব দ্রুততার সঙ্গে শেষ করে একটা নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে। এই নির্বাচন যেন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। তিনি তার দেওয়া কথা রাখার পথেই হাঁটছেন। নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢেলে সাজানো, নির্বাচন কমিশনকে কাজ গুছিয়ে নেওয়ার নির্দেশ অবশ্যই ইতিবাচক।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না। যথাসময়ে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা তার সুনাম ধরে রাখবেন বলেও আমরা বিশ্বাস করি।’
জামায়াতের ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ ইতিবাচক। নিরপেক্ষভাবে ভোট করতে অনেক কাজ থাকে। এ জন্য নির্বাচনের চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। এবার একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা জনগণের। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।’
‘আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু বারবার একটি অপশক্তি সেই পথে বাধার সৃষ্টি করছে। কিছু দূর এগিয়ে আবার কিছু দূর পিছিয়ে যাচ্ছি’ বলে যোগ করেন জামায়াতের এই শীর্ষ নেতা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচন নিয়ে জনগণের বিভ্রান্তি দূর করার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের এক ধরনের বার্তাও দিতে চেয়েছেন। তার ঘনিষ্ঠজনরা জানান, আন্তর্জাতিকভাবে তার ন্যূনতম কোনো দুর্নাম হোক তা চান না ড. ইউনূস। বিশ্বজুড়ে তার যে সুনাম রয়েছে সেই সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে চান তিনি।
এ কারণে তিনি যেনতেনভাবে আরেকটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক সেটি কিছুতেই চান না। ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল এবং শেখ হাসিনার সময়ে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের মতো কোনো নির্বাচন হোক তিনি সেটি চান না।
তাছাড়া নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে এক ধরনের চাপ রয়েছে। পাশাপাশি বিএনপিসহ দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই কোনো সংঘাতে যেতে চান না ড. ইউনূস। তিনি নির্বাচিত সরকারের হাতে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজের কাজে চলে যাওয়ার বিষয়ে বদ্ধপরিকর।
সবদিক মিলিয়ে নিজের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কোনো দিকে না তাকিয়ে তার প্রেস উইংয়ের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যাপারে এই ঘোষণা দিয়েছেন বলে জানা যায়। একই কৌশল বা মনোভাব থেকে অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপিকেও আশ্বস্ত করেছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে এপ্রিল বা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। বিরোধীদের পাশাপাশি বিএনপিও এ নিয়ে নানা কথাবার্তা বলেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন করা সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপিকে আরেক দফা আশ্বস্ত করলেন ড. ইউনূস। এর মধ্য দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এমন বার্তা দিলেন যে পরিস্থিতি যাই হোক নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্বাচনের আগে ঢেলে সাজানোর বার্তা দেওয়া হলো। কারণ পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বলে আলোচনা আছে। তারা নির্বাচন করার মতো অবস্থায় আছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে জনমনে। ফলে এই বার্তার মধ্য দিয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুনর্গঠন করতে চাইছেন প্রধান উপদেষ্টা।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘মানুষের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে অনেক সংশয় ছিল বলে আমি মনে করি, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশের কারণে এখন সেই বিভ্রান্তি বা সংশয় দূর হলো। এখন মনে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের কাজ করছে এবং যথাসময়ে নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি হোক আর এপ্রিলে হোক- এরপর আর ড. ইউনূস সরকারে থাকবেন না। যতদূর ঐক্য হয়েছে ততদূর পর্যন্ত তারা সংস্কার সম্পন্ন করবেন, বাকিগুলো ভবিষ্যতের জন্য ছেড়ে দেবেন।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি। আমরা আশা করি, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সব স্তরে এই নির্দেশ বেশ গতি সৃষ্টি করবে। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় তৈরি হয়েছে, তা এর মাধ্যমে অনেকটাই কেটে যাবে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। পুরোপুরি সংশয় দূর হয়নি। এখনো যদি কিন্তু রয়ে গেছে। কারণ এ কথাগুলো বলবে নির্বাচন কমিশন। তারা যদি বলত আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনে যাবতীয় কাজ শেষ করব, তাহলে সংশয় পুরোপুরি দূর হতো। এটাই জনগণের প্রত্যাশা ছিল।’
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ নির্বাচনের ব্যাপারে একটা অগ্রগতি। চারদিকে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন গুজব, গুঞ্জন ও নানা চক্রান্ত চলছে। প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে নির্বাচন। আমরা তার কথা ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার ও নির্বাচন কমিশন যে প্রস্তুতি নিচ্ছে তাতে আমরা ধারণা করছি, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে নির্বাচন হবে। যত দ্রুত দেশ নির্বাচনের ট্র্যাকে উঠবে ততই দেশের জন্য মঙ্গলজনক।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘প্রথম অগ্রাধিকার হলো রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার। বিশেষ করে জুলাই গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কার। আর নির্বাচন হলো দ্বিতীয় অগ্রাধিকার। কিন্তু সরকার মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে কোনো কথা বলছে না। এটা জুলাইযোদ্ধাদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতারণার শামিল। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে সরকার তড়িঘড়ি করছে। সরকার ঘোষণা দিয়ে বলুক তারা নির্বাচন দেওয়ার জন্য এসেছে। বর্তমানে সরকার ও নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। এদের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের বিপক্ষে নই। কিন্তু নির্বাচনের পাশাপাশি গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের রোডম্যাপ দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা এই বিষয়ে কোনো ধারণা না দিয়ে, শুধু নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহিদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে। আমরা আশা করব, সরকার দ্রুত বিচার ও সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।’