Image description
বিবিএস’র প্রতিবেদন । মূল চ্যালেঞ্জ বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা । চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেই সরকারের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ।

দেশে তারুণ্যের জনমিতি সুবিধা ফুরিয়ে আসতে থাকায় দিন দিন বাড়ছে প্রবীণের সংখ্যা। যা আগামী দিনগুলোতে নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা বেশি না বাড়লেও ২০২১ সাল থেকে এই প্রবণতা বাড়তে শুরু করেছে। তবে আগামী বছর (২০২৬ সাল) থেকে এই বৃদ্ধি আরও জেরেশোরে হবে বলে এক প্রক্ষেপণ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বৃহস্পতিবার ‘পপুলেশন প্রজেকশন অব বাংলাদেশ: ডায়নামিস এন্ড ট্রেন্ডস ২০১১-২০৬১’ শীর্ষক বিবিএসের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন চিত্র ওঠে এসেছে। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আগামী দিনগুলোতে প্রবীণ জনসংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ থাকলেও এর পরিসর খুবই সীমিত।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বয়স্কদের অংশ আগামীতে বাড়বে। এর ফলে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। এক্ষেত্রে সরকারের খুব বেশি প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। তবে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যেই কিছু ওল্ডহোম তৈরির কাজ শুরু করেছেন। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব ওল্ডহোম সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই বেশি করা হচ্ছে। তবে যাতে আগামীতে এমন কাজ আরও বেশি বৃদ্ধি পায় সেজন্য সরকারকে একটা আইনি ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে আইন বাস্তবায়নে রেগুলেটরি কাঠামো থাকতে হবে। এর পাশাপাশি সরকারের চলমান বয়স্ক ভাতার কর্মসূচিতে টাকার অঙ্ক বাড়ানোর সঙ্গে এর আওতাও সম্প্রসারণ প্রয়োজন। তবে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে সরকার চাইলেও সব বৃদ্ধকে ভাতা দিতে পারবে না। এক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশন স্কিম সচল করার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে।

বিবিএসের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৬৫ থেকে উপরের বয়সের ব্যক্তিকে সাধারণত বয়স্ক হিসাবে ধরা হয়। সে হিসাবে ২০১১ সালে যেখানে মোট জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ ছিল বয়স্ক মানুষ- সেটি ২০১৬ সালে এসে কিছুটা কমে হয়েছিল ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০২১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশে। আগামী বছর ২০২৬ সালে এটা আরও বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০৩১ সালে হবে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ, ২০৩৬ সালে সেটি হতে পারে ১২ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ২০৪১ সালে হতে পারে ১৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ২০৪৬ সালে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে। এ ছাড়া ২০৫১ সালে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২০৫৬ সালে ২১ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ২০৬১ সালে গিয়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ২৪ দশমিক ৮১ শতাংশে।

এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সিয়েরালিয়নের আন্তর্জাতিক পরামর্শক ড. ইয়াছমিন সিদ্দিকা যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে তাদের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি দরকার। বয়স হলেও তারা তো কর্মক্ষম ও অভিজ্ঞ হয়ে যান। তাদের সেই অভিজ্ঞতাকে কিভাবে দেশের কাজে লাগানো যায় সেটি ভাবতে হবে। এ ছাড়া বয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্য ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা হয়তো তাদের মৃত্যু ঠেকাতে পারব না। কিন্তু শেষ বয়সে এসে তারা যাতে যন্ত্রণামুক্তভাবে থাকতে পারেন সেজন্য সরকারি উদ্যোগ জরুরি। এক্ষেত্রে শুধু শারীরিক অসুস্থতাই নয়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আমাদের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে গেছে। তাই শেষ বয়সে বাবা-মায়েরা একা হয়ে যান। তাদের জন্য বিনোদনসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবশ্যই সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। সেটি করা না গেলে শেষ জীবনে এসে এই শ্রেণির জনগোষ্ঠী অসহায় হয়ে পড়বে।

বিবিএসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১১ সালে দেশে প্রবীণের সংখ্যা ছিল এক কোটি ১১ লাখ ৯৯ হাজার। সেটি ২০১৬ সালে হয়েছে এক কোটি ১৮ লাখ ২৯ হাজার। ২০২১ সালে এক কোটি ৪১ লাখ ৭০ হাজার জন। আগামী বছর ২০২৬ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৬৭ লাখ ৭৬ হাজারে। এ ছাড়া ২০৩১ সালে দুই কোটি সাত লাখ ১৪ হাজার। ২০৩৬ সালে গিয়ে দাঁড়াবে দুই কোটি ৫১ লাখ ৭৬ হাজার। ২০৪১ সালে হতে পারে দুই কোটি ৯৯ লাখ ৬৭ হাজার, ২০৪৬ সালে তিন কোটি ৬৬ লাখ ৮০ হাজার, ২০৫১ সালে হতে পারে চার কোটি ২৩ লাখ ৩৮ হাজার, ২০৫৬ সালে চার কোটি ৭০ লাখ ৫৯ হাজার এবং ২০৬১ সালে বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে পাঁচ কোটি ৪৪ লাখ ৯৯ হাজারে।

বিবিএসের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা, এসডিজি সেল আলমগীর হোসেন বলেন, স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) ২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫ বছরেই বয়স্কদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ। ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার মূল চ্যালেঞ্জ হলো তাদের বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। কেননা বয়স্ক মানুষদের অসংক্রামক রোগের প্রবণতা বেশি থাকায় তাদের জন্য পৃথক চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা উচিত। বিশেষ করে এলাকাভিত্তিক বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। দেশে যেভাবে বয়স্ক মানুষ বাড়ছে, এতে এখন থেকেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।