Image description

রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। এসব কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাবনার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। সেপ্টেম্বরে গঠিত হওয়া ৬ কমিশন ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ তাদের সংস্কার প্রস্তাব সরকারকে জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে সংস্কার প্রস্তাবনা শেষ না হওয়ায় নতুন করে সময় বাড়িয়েছে সরকার। ৬ কমিশনের ৫টিকে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ১৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। আর একটি কমিশনের সময় ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ইতিমধ্যে সংস্কার প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছেন। এখন শেষ সময়ের ঘষামাজা চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তারা তাদের সুপারিশ সরকারকে জমা দিতে পারবেন। জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, আমরা আমাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। ১৫ই জানুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করতে পারলে সরকারকে আমরা আমাদের রিপোর্ট জমা দেবো। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সংস্কার প্রস্তাবনা। কমিশনের দেয়া সংস্কার কতোটুকু মেনে নেবে রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ ইতিমধ্যে বিএনপি সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সংবিধান সহ কয়েকটি খাতের সংস্কার নিয়ে নিজেদের আপত্তি জানিয়েছে। তারা বলছেন, সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। এটি নির্বাচিত সরকারের কাজ। তাই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংস্কার করতে পারা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিষয়টি নিয়ে ভাবছে সরকারও। গত ১৬ই ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, যেকোনো সংস্কারের কাজে হাত দিতে গেলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন। তাই ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠন করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। এ কমিশনের কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের মতামত গ্রহণ করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে সেগুলো চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্য কতোটুকু মানবে শিক্ষার্থীরা তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কারণ গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীরা বড় আকারে সংস্কার চাইছেন তাদের সংস্কার প্রস্তাবনায়। ছাত্রদের প্ল্যাটফরম থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটিও ইতিমধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনকে তাদের সংস্কার প্রস্তাবনা দিয়েছে। এ ছাড়া, ছাত্ররা ’৭২-এর সংবিধানকে মুজিববাদী আখ্যা দিয়ে নতুন করে সংবিধান পুনর্লিখনেরও দাবি জানিয়ে রেখেছে। 

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন কঠিন সরকারের কাছে। তবে তা একেবারেই অসম্ভব না। এর জন্য সরকারকে সক্ষমতা দেখাতে হবে। কারণ সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। অন্যদিকে জনপ্রশাসনের কিছু সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। বিষয়গুলো নিয়ে তারা নিজেদের অবস্থানও স্পষ্ট করেছেন। অন্যদিকে বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের আপত্তি মানতে নারাজ। তারা মনে করছেন প্রশাসন ক্যাডারের অতিরিক্ত ক্ষমতায়নের কারণে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারি মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচন, সংস্কার ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে রাজনৈতিক দল ও ছাত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। যত দিন যাবে সেটি তত স্পষ্ট হবে। সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এর মধ্যে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা অন্যতম। কারণ সংবিধানকে বলা হয় ফান্ডামেন্টাল অব ইনস্টিটিউট। গত ১৫ বছরে সরকার সংবিধান দুর্বল করার মাধ্যমে এসব ইনস্টিটিউটকে ধ্বংস করেছে। তাই এটিকে একটি সঠিক ভিত্তির ওপর না আনা গেলে সব আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। বিষয় হচ্ছে কতোদিন হবে। সরকারকে এটির মীমাংসা করতে হবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন গঠনের কথা বলেছেন- আমি মনে করি এর জন্য রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করা অভিজ্ঞ লোকদের নিয়ে এ কমিশন গঠন করা উচিত। যাদের সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এ কমিশন সবার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয় নির্ধারণ করবে। এখানে ছাত্রদেরও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তারা এ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন।  

১১ই সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ছয় কমিশন গঠনের কথা জানান প্রধান উপদেষ্টা। এরপর সরকার ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সরফরাজ চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করে। শুরুতে এসব কমিশনকে ৩ মাস সময় দেয়া হলেও সম্প্রতি আরও ১৫ দিন সময় বাড়ানো হয়। এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয়া হয়। জানা গেছে, সংস্কার কমিশনগুলো থেকে সংস্কার প্রস্তাব পাওয়ার পর সরকার ৬ কমিশনের প্রধানদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করবে। এর নেতৃত্ব দেবেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. আলী রীয়াজ। তবে এ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। সব কমিশন থেকে সংস্কার প্রস্তাব পাওয়ার পরই তারা কাজ শুরু করবেন। প্রয়োজনে এর সদস্য সংখ্যা আরও যোগ করা যেতে পারে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ কমিশন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে বসবেন। এর মধ্যে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র প্রতিনিধিও থাকবেন। সবার মতামত নিয়ে যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে আসা যাবে কেবল সেগুলো সংস্কার করা যাবে। তবে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দল ও ছাত্রদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্ররা সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি করে রেখেছে। এ ছাড়াও তারা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলছে। এমন অবস্থায় সংস্কার কোন পথে হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। 

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, সংস্কার নির্ভর করছে আমাদের অংশীজনরা কী চাচ্ছে। সরকারের সঙ্গে সংলাপে তারা কী আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। বা কতোটুকু সংস্কার তারা চান। একটা দেশের জন্য সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। বছরের পর বছর লাগে এটা করতে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। তারা মনে করেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকার থাকে তাহলে তারা অনেকগুলো সংস্কার করে যেতে পারবে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। সে আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করার জন্য এতগুলো সংস্কার কমিশন করে দেয়া হয়েছে। যেন আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থায় ফিরতে পারি। এর জন্য যতগুলো সংস্কার লাগে আমরা অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার হবে। এদিকে গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রেস সচিব বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি সংস্কার না চাইলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

গত ৪ঠা জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, নির্বাচনের সময় দীর্ঘ হলে নতুন ষড়যন্ত্র হতে পারে। গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের সব বিভাগ যে পরিমাণ দলীয়করণ আর দুর্নীতিতে ডুবে গেছে, সবটা সংস্কার করা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। রাষ্ট্রের পূর্ণ সংস্কার, একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে তার দ্বারাই হবে। তবে আমরা বলেছি, একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমপক্ষে রাষ্ট্রের যে সমস্ত বিভাগ সংস্কার করা প্রয়োজন, যেমন নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন- এ রকম নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫/৭টি বিভাগকে সংস্কার করে ৬ থেকে ৭ মাসের মধ্যে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। তারপরে নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমরা বলেছি। 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৭শে ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেন, সংস্কার নিয়ে যত বেশি সময় যাবে, সমস্যাগুলো তত বাড়বে। আসল সমস্যা তো অন্য জায়গায়। সরকার এটা বাস্তবায়ন করবে কাদের দিয়ে? বিএনপি সংস্কার চায় না, নির্বাচন চায়- এই অভিযোগ সঠিক নয়। সংস্কারে আন্তরিক বিএনপি। বারবার বলছি, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচন চাই। গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যেতে হলে নির্বাচন প্রয়োজন। তিনি বলেন, জনগণকে বাদ দিয়ে উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কিছু করা যাবে না। আমরা চাই, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজগুলো করবো।