
দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর হয়ে বিদেশে যাতায়াতকারী ই-পাসপোর্টধারী যাত্রীদের সেবা আরও বাড়াতে স্থাপিত ৪৫টি ই-গেট স্থাপন করা হলেও তা কারও কাজে আসছে না। সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব ই-গেট কেন করা হলো, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুন সময়কালের মধ্যে ই-গেট স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করে। যাত্রীসেবা নিশ্চিতে ৪৫টি ই-গেট নির্মাণের পর তাতে সেবা না বাড়লেও প্রকল্পের টাকা পকেটে ভরতে আরও ৭টি ই-গেট স্থাপনের কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব গেট দিয়ে যাত্রী পার হওয়ার পরও আবার দাঁড়াতে হচ্ছে ইমিগ্রেশন লাইনে। এতে যাত্রীদের ললাটে যে বিড়ম্বনা ছিল, সেটি পিছু ছাড়ছে না। উলটো হয়রানি আরও বেড়েছে। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে ‘বাংলাদেশ ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন’ শীর্ষক প্রকল্পের ‘ই-গেট’ নির্মাণ অংশে যাত্রীদের সেবা লাটে ওঠার এমন কথা উঠে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এটি অবশ্যই অপচয়। যে সুবিধার জন্য এ প্রযুক্তি স্থাপন করা হলো, সেই সেবা মিলছে না। বরং আবারও ওই ইমিগ্রেশনের লাইনেই দাঁড়াতে হচ্ছে যাত্রীদের। এক্ষেত্রে ইফিসিয়েন্সি বাড়াচ্ছে না। এটি প্রকল্প তৈরির সময়ের দুর্বলতা। প্রশ্ন জাগে, তখন আদৌ এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছিল কি না। যদি হয়ে থাকে, তাহলে বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই কেন। আবার যদি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না হয়, তাহলে এটি ছাড়া কীভাবে একটি নতুন প্রযুক্তি স্থাপন করা হলো। ই-গেট নির্মাণের বিষয়টি অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেমন দায়ী, তেমনই পকিল্পনা কমিশনও দায়ী।
জানা যায়, নতুন ৭টিসহ ৫২টি ই-গেট স্থাপনে ব্যয় হয়েছে ৩৪ কোটি ৫৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু স্থাপন করার পর থেকেই এগুলোর কার্যকর ব্যবহার হচ্ছে না। ‘বাংলাদেশ ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন’ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৬৩৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রহস্যজনক কারণে ওই ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৯ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের অনুমোদিত মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত। এর মধ্যে চলতি বছরের মার্চে খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৮৯৪ কোটি ৪ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৫৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। তবে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭৫ শতাংশ। এটি বাস্তবায়ন করছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা আরও হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৬টি ই-গেট স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে আগমনিতে ১২টি, বহির্গমনে ১২টি এবং ভিআইপিতে ২টি ই-গেট বসানো হয়। আইএমইডির কর্মকর্তারা সরেজমিন ঘুরে দেখেন, ইমিগ্রেশন পুলিশ এসব গেট ব্যবহারে যাত্রীদের উৎসাহ দিচ্ছেন না। এ সময় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা জানান, ই-গেট স্থাপনের আগে বলা হয়েছিল মাত্র ১৮ সেকেন্ডেই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে ই-গেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুধু পাসপোর্ট ও যাত্রীকে শনাক্ত করতে পারছে। এদিকে ই-গেট পার হওয়ার পর পাসপোর্টের সব তথ্য ডেস্কে না আসায় ইমিগ্রেশন ডেস্কে আগের মতোই যাত্রীদের ভিসা ও অন্যান্য তথ্য যাচাই করার প্রয়োজন হচ্ছে। এতে আগের তুলনায় এখন আরও বেশি সময় লাগে। যাত্রীরা জানান, ই-গেট ব্যবহারের পর আবার ম্যানুয়ালি লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এতে দ্বিগুণ সময় ও বিড়ম্বনা তৈরি হয়।
ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামের হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৬টি ই-গেট স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ৩টি বিদেশ যাওয়ার জন্য এবং ৩টি আগত যাত্রীদের জন্য। কিন্তু এসব গেট ব্যবহার করার জন্য কোনো সাইন বা সিগন্যাল নেই। এছাড়া ইমিগ্রেশন ফ্লোরের এক কোনায় স্থাপন করা হয়েছে আগমনের ই-গেট।
সরেজমিন দেখা যায়, যাত্রীরা ই-গেট ব্যবহার না করে এড়িয়ে যান। এ সময় দেখা যায়, ই-গেটে একজন যাত্রী ই-পাসপোর্ট স্ক্যান করে বের হতে ১৭-১৮ সেকেন্ডে সময় লাগে। এখানে সিস্টেম হলো স্ক্যানে পাসপোর্ট ঠিক থাকলে একটি দরজা খুলে যায়। একটু এগিয়ে পরের গেটে গেলে সেখানে ক্যামেরায় অটোমেটিক পাসপোর্টধারীর মুখ ও চোখ স্ক্যান করে। পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে যাত্রীর চেহারা মিলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরের গেটটি খুলে যায়। আর ছবি না মিললে বা পাসপোর্ট ভুয়া হলে ওই গেটটি খোলে না। কিন্তু সমস্যা হলো-কোন যাত্রীর চেহারা যদি পরিবর্তন হয়, যেমন হিজাব পরা, আগে দাড়ি না থাকলেও এখন আছে, সাইজে একটু ছোট হলেও গেট খুলে না। তখন ওই যাত্রীকে ম্যানুয়ালি ইমিগ্রেশন করতে হয়। আবার যারা ই-গেট ব্যবহার করছেন, তাদের ভিসা যাচাইসহ অন্যান্য কাজের জন্য ফের ইমিগ্রেশন ডেস্কে যেতে হয়। ফলে আগের মতোই বেশি সময় লাগে। এতে যাত্রী রাগান্বিত হয়ে যান। এছাড়া অনেক সময় ই-গেট সফটওয়্যারে ডেটা ইমিগ্রেশন সফটওয়্যারে আসে না। এটি একটি বড় সমস্যা। এই বিমানবন্দরে কয়েকজন প্রবাসী আইএমইডির তদন্তদলকে বলেন, দীর্ঘসময় জার্নি করে এসে ইমিগ্রেশনে লাইনে দাঁড়ানো খুব কষ্টকর। আবার দেখা যায়, ই-গেট দিয়ে পার হয়ে আবার এমআরপি পাসপোর্টধারীদের পেছনে দাঁড়াতে হয়।
যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে চারটি ই-গেট স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে দুটি ভারতে যাওয়া এবং দুটি বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য। এখানেও ই-গেটের কার্যকারিতা খুঁজে পায়নি আইএমইডি। এখানে ই-গেটের তথ্য সম্পর্কিত কোনো নির্দেশনা নেই।
ই-গেটে প্রয়োজনীয় কর্মী নেই। এই গেটের সঙ্গে ইমিগ্রেশন ডেস্কের অ্যালাইনমেন্ট নেই। এছাড়া এখানে ১২/১৪টি ইমিগ্রেশন ডেস্ক আছে। এগুলোর সঙ্গে মাত্র দুটি ই-গেটের সমন্বয় করা সম্ভব নয়। একই অবস্থা পঞ্চগড়ের বাংলাবান্দা স্থলবন্দরে। এখানে একটি আগমন এবং একটি বহির্গমন ই-গেট রয়েছে। এখানেও অন্য বন্দরগুলোর মতো ই-গেটের মাধ্যমে পার হলেও যাত্রী হয়রানি রয়েছে।
যদিও প্রতিবেদনের একাংশে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলছে। ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনার জন্য রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ীতে একটি ডেটা সেন্টার স্থাপন করা হয়। সরেজমিন দেখা যায়, অফিস চলাকালনী প্রায়ই কিছু সময়ের জন্য সার্ভার ডাউন থাকে। ফলে কাউন্টারগুলোয় আগত সেবাগ্রহীতাদের দীর্ঘ লাইন লেগে যায়। এতে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়, অনেকেই রাগান্বিত হয়ে তেড়েও আসেন।