
প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা নারী কেলেঙ্কারি ঘটনায় জড়িত এবং রাতের ভোটের সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের দায়িত্ব পালনকারী ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের উপসচিব পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। এ তালিকা সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের পছন্দের উপজেলা মিঠামইন এর ইউএনও মো. এরশাদ মিয়া। ফ্যাসিস্ট এরশাদ গত ৫ আগস্ট সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিল। সেও এখন নরসিংদীর এডিসি। এছাড়া সিলেটের গোয়াইন ঘাটের ইউএনও মো. তৌহিদুর ইসলাম ৫ আগস্ট সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিল। তাকে কুমিল্লা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) পদে বদলি করা হয়েছে। রাতের ভোটের সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের উপসচিব পদোন্নতির জোর তদবির শুরু হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। রাতের ভোটের সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের পদোন্নতি দেয়ার জন্য কয়েকটি এসএসবি সভা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের একটি সার-সংক্ষেপ তৈরি করা হচ্ছে। তা যে কোনো সময় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হতে পারে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ আমলের বিভিন্ন অনিয়মের প্রতিকারে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিলেও নির্বাচনের সঙ্গে জালিয়াতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তি এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার একাদশ নির্বাচনের ছয় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছে। কয়েকজনকে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করা হয়েছে। বাকিরা আগের পদেই রয়েছেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, প্রশাসনে যেসব কর্মকর্তা চাকরিবিধি ও আইন লঙ্ঘন করে ভোট কারচুপিতে জড়িত ছিলেন, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের।’ কবে কীভাবে এই ব্যবস্থা নেওয়া হবেÑ তা স্পষ্ট করেননি উপদেষ্টা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে জানান, গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ডিসি হিসেবে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ২২ কর্মকর্তাকে ফেব্রুয়ারিতে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। আবার ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা তৎকালীন ৩৩ ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে। একইভাবে যারা এসপির দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরও বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি করা হয়েছে। কিন্তু বিসিএস ৩০তম প্রশাসন ক্যাডারে ২৭৭ জন কর্মকর্তাকে ২০১২ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে নিয়োগ দেয়া হয়। এই কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই ২০১৮ নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে রাতের ভোট সম্পন্ন করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর এই কর্মকর্তারাই ভোল পাল্টিয়ে নিজেদের বঞ্চিত দাবী করতে শুরু করে। রাতের ভোটে দায়িত্ব পালন করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে প্রাইজ পোস্টিং নিয়ে এবার তারা উপসচিব পদোন্নতির জন্য জোর তদবির চালাচ্ছে। এ ব্যাচের পদোন্নতি দেয়ার জন্য সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের একান্ত সচিব এবং বর্তমান সচিবের একান্ত সচিব উপসচিব পদোন্নতির জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা সকলেই রাতের ভোটের সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
নারী কেলেঙ্কারি ঘটনায় ওএসডি হওয়া আক্কেলপুরের সেই ইউএনও এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশি বিভাগীয় এস্টেটের বিতর্কিত অফিসার (ডিইও)। তিনি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর চুক্তিভিত্তিক পাকশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (ডিইও) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিয়োগ পেয়েই রেলের জমির লিজ বাতিল এবং ক্ষতিপূরণ লাইসেন্স ও লিজ গ্রহীতাদের রাজস্ব গ্রহণ না করে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। তিনি লিজ গ্রহণকারীদের নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বিভিন্ন কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে তার নামে। চলমান সময়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে যাওয়া লিজ গ্রহীতাদের নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগও কম নয়। প্রতি বছর বাংলা সন চৈত্র-বৈশাখ দুই মাস রেলওয়ের জমি লিজ দেওয়া ২৭ হাজার লাইসেন্সের রাজস্ব আদায় এবং লাইসেন্স নবায়ন (সময় বৃদ্ধি) করা হয়। সেক্ষেত্রেও আরিফুলের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ খাজনা পরিশোধের আবেদন জমা দিলে পরবর্তী একটা তারিখ দেয় ডিইও আরিফুল। নির্ধারিত সময়ে আবেদনকারী ভূমি অফিসে হাজির হয়ে রাজস্ব গ্রহণের প্রস্তাব দিলে আবেদনের ফাইল খুঁজে পায়না ডিইওর দপ্তর। এভাবে হয়রানি করা হয় খাজনা প্রদানকারীদের। বর্তমান পাকশির ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ করেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার শাহাদত হোসেন।
তিনি বলেন,আমার লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬ মাস পূর্বেই বিত্তশালী একব্যক্তিকে টেন্ডার ছাড়া পুকুর লিজ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তকারী জানান, ডিইও আরিফুল ইসলাম একক ক্ষমতা বলে নিজের খেয়াল খুশিতে লিজ বাতিল করে তার পছন্দের উৎকোচ দাতাকে টেন্ডার ছাড়াই লিজ দেন। কৃষি লাইসেন্স নিয়ে নাটোর স্টেশন সংলগ্ন রেল কর্মচারীদের স্টাফ কোয়ার্টার দখল করে বাণিজ্যিক ব্যবসা করছে ডিনার। অনলাইন গণমাধ্যম এফএনএসে প্রতিবেদন প্রকাশের পর চলতি বছরের ১৩ ফ্রেরুয়ারি পাকশির ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা ডিনারের দোকান সিলগালা করেন। কয়েকদিন পর রফাদফায় ফের খুলে দেওয়া হয় তার দোকান। আর এসব অনিয়মের মধ্যস্থতাকারী পাকশির সাবেক অফিস সহকারী শেখ জাবের আলী।
গত ১৬ মে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে স্বাক্ষর করে মাফুলার দোকান না থাকলেও রফাদফায় অবৈধভাবে তার রাজস্ব গ্রহণ করা হয়। রেলভবনে ভূ-সম্পত্তি বিভাগের উপপরিচালক গৌতম বিশ্বাস বলেন,ক্ষতিপূরণ কোন লাইসেন্স না। ক্ষতিপূরণ লাইসেন্সের বিপরীতে মাফুলার পক্ষে খাজনা গ্রহণের চেকে জাবেরের স্বাক্ষর করা বিধির পরিপন্থী বলে জানিয়েছেন সহকারী পরিচালক গোলাম মোস্তফা। ডিইওর দপ্তরের বিরুদ্ধে এসব ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় রেলকর্তৃপক্ষ গত ২০মে শেখ জাবের আলী এবং উচ্চমান অফিস সহকারী মমতাজুলকে চট্টগ্রাম বদলি অর্ডার করে রেলওয়ের মহাপরিচালক। কাকতালীয়ভাবে একই তারিখে রাজশাহীর অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মাসুম (জিএম) ৪ জনের আরেকটি বদলি অর্ডার করেন। সেই আদেশে উচ্চমান সহকারী মমতাজুল হাসানকে রাজশাহী সিইওর দপ্তর,অফিস সহকারী শেখ জাবের আলীকে পাকশি থেকে লালমনিরহাট ডিইওর দপ্তর (পদ খালি নাই), একেএম রাশেদুল ইসলাম, ট্রেসারকে লালমনিরহাট ডিইওর দপ্তর এবং অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মোল্লা ইকরামুলকে সমপদে লালমনিরহাট ডিইওর দপ্তরে বদলি করা হয়। বর্তমান ডিইও আরিফুল ইসলামের সাথে ২দিন লালমনিরহাট তিনদিন পাকশির ডিইওর দপ্তরে ডিউটি করেন বলে জানা গেছে। লালমনিরহাট ডিইওর দপ্তর সূত্র বলছে এই দপ্তরে অফিস সহকারী পদখালি না থাকায় জাবের আরিফুল ইসলামের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। ডিইও যেখানে জাবের সেখানে।
পাকশির ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম (ডিইও) বলেন, আমার দপ্তরে কাজের লোকবল সংকট হওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া তিনি দুইটি বিভাগের দায়িত্ব পালন করায় সুষ্ঠুভাবে কোন কাজ করা সম্ভব হয় না। তিনি পাকশি বিভাগে সপ্তাহে তিনদিন এবং বাকি দুইদিন লালমনিরহাট ডিভিশনে অফিস করেন। জিএমের দপ্তর সূত্রে বলা হয়, ভারপ্রাপ্ত জিএম মাসুম কৌশলে জাবেরকে এই সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে। সময় সুযোগ বুঝে আরেকটি অর্ডার করে তাকে রাজশাহী চীফ ইঞ্জিনিয়ারের দপ্তরে সংযুক্ত করা হবে বলে জানা গেছে। সেখানে সপ্তাহের দুইদিন ডিউটি করবে বাকি তিনদিন অফিস করবে পাকশি ডিইওর অধীনে। এমন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল জিএম দপ্তর। পাকশির ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা ডিইওর দায়িত্ব গ্রহণের পর তিন মাসের মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতির আলোচনায় শীর্ষে উঠে আসে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরিফুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিধি লঙ্ঘন করে ক্ষতিপূরণ লাইসেন্সের বিপরীতে রাজস্ব গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। লাইসেন্স নবায়নে লিজ গ্রহীতাদের নিকট থেকে ঘুষ কেলেঙ্কারির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার নামে।
আব্দুলপুরের আলেয়া খাতুন ওরফে পাঁচির অভিযোগ বাংলাদেশ রেলওয়ের জলাশয় জমি বৈধভাবে ২০০৪ সালে লিজ গ্রহণ করেন তিনি। নিয়মিতভাবে সরকারকে রাজস্ব প্রদান করে আসছে আলেয়া খাতুন। তার জমির একাংশের মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করেন মতিউর রহমান। আদালত রায় দেন ওই জমির লিজ সূত্রে প্রকৃত মালিক পাঁচি বিবি। পাকশির ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম আলেয়াকে নানাভাবে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ পাঁচির। আক্কেলপুর ইউএনওর দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে ওঠা নারী কেলেঙ্কারী ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। মিডিয়ায় পাওয়া তথ্য-চিত্রে দেখা যায় ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আক্কেলপুর ইউএনওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন আরিফুল। দায়িত্ব নেওয়ার পর তার কার্যালয়ের সামনে দেড় বছরের বাচ্চা বুকে নিয়ে মা জান্নাত আরা খাতুন স্ত্রীর মর্যাদা চেয়ে রাস্তায় অবস্থান নেয় দিনাজপুরের গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষিকা। এ ঘটনাটি আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ার পর বিষয়টি নজরে আসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। তার এমন কর্মকা- দৃষ্টিকটুর হওয়ায় ২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যুক্ত করা হয়। তার প্রত্যাহার করা প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব কানিজ ফাতিমা। অফিস সহকারী জাবের পাকশির ডিইওর দপ্তরে ডিউটি করার কথা অস্বীকার করেন।