Image description

বাংলাদেশের ছয়টি বিশেষায়িত ব্যাংক এক ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েছে। অস্বাভাবিক হারে ঋণখেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতির কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে শুধু ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হয়নি, বরং সামগ্রিক অর্থনীতি ও দেশের আর্থিক শৃঙ্খলার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও হতাশা বিরাজ করছে।

বিষয়টি সম্প্রতি আরও স্পষ্ট হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে ছয়টি বিশেষায়িত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বৈঠকে। এই ব্যাংকগুলো হলো—বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি) ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের এক বৈঠকে এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা উন্মোচিত হয়।

বিশেষ করে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত এর মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি।

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, ব্যাংকগুলোর শৃঙ্খলাহীন কার্যক্রম, সময়মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই এই সঙ্কটের মূল কারণ।

ব্যাংকে ঋণখেলাপি বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এসব ব্যাংকে শ্রেণিকৃত (খেলাপি) ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২,২০০ কোটি টাকা বেশি।

২০২৩ সালের জুনে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। কিছুটা হ্রাসের পর ২০২৫ সালের মার্চে আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।

বিভিন্ন মামলায় রিট জটিলতায় আটকে আছে আদায় প্রক্রিয়া। আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, জামানত বাজেয়াপ্তে বাধা, গ্রাহকদের ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপ- এগুলোই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনায় ঋণ পুনঃতফসিলের সময়সীমা কমানো হয়েছে, যা অনেক ব্যাংকের মতে খেলাপির সংখ্যা আরও বাড়াবে।

কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে, মূল ও সুদ দ্বিগুণ হয়ে গেলে আর সুদ আরোপ করা যাবে না—এটি ঋণগ্রহীতাদের ঋণ ফেরত না দেওয়ার ‘ছাড়পত্র’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর জানা গেছে, পূর্ববর্তী সরকারের সময় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এমন ঘটনা বিশ্বের কোথাও নেই, যেখানে ব্যাংকের আমানতের ৮০ ভাগ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস।”

বৈঠকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রত্যেক ব্যাংককে তাদের শীর্ষ খেলাপিদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে এবং একটি সুস্পষ্ট আদায় পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে মূলধন ঘাটতি পূরণে প্রয়োজনে পুনর্গঠন প্রকল্প গ্রহণ, নতুন গ্রাহকের ঋণ বিতরণে সতর্কতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করার কথা বলা হয়।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিনতে আলী বলেন, “আমাদের সম্পদের পরিমাণ ও গুণগত মান কমে যাওয়ায় পারফর্মিং লোন কমেছে। এখন আমরা কার্যকর ঋণ আদায়ে মনোযোগ দিচ্ছি।” অন্যদিকে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক পুনর্গঠনের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ওয়াহিদা বেগম বলেন, “২০০৩ সালের পুনর্গঠনের কাজ চলছে। আদায়ই আমাদের মূল অগ্রাধিকার।”

বাংলাদেশের এই ছয়টি বিশেষায়িত ব্যাংকের সংকট দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গভীর সতর্কবার্তা। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্নীতির ফলে আজ ব্যাংকগুলো কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনই প্রয়োজন দ্রুত, কঠোর এবং স্বচ্ছ পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে জনগণের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা আরও বিশৃঙ্খল না হয়ে পড়ে।