Image description

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও ‘রাজাকার কমান্ডার’ মোবারক হোসেনকে ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে (ক্রিমিনাল আপিল ১৪৮/১৪) আপিল করেন তিনি। প্রায় ১১ বছর পরও ওই আপিলের নিষ্পত্তি হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের সূত্র বলেছে, মোবারকের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ৫২ জনের করা আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। তাঁদের অনেকে বছরের পর বছর রয়েছেন কারাগারের কনডেম সেলে। কারও কারও কেটেছে এক দশক।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা এসব আসামির আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে তাঁরা মনে করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেনসহ বেশ কয়েকজন আসামির পক্ষে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে রয়েছেন সিনিয়র আইনজীবী ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এস এম শাহজাহান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, এসব মামলার শুনানিতে তারিখ নির্ধারণের জন্য তাঁরা আদালতের নজরে আনবেন। যেহেতু একটি (এ টি এম আজহারুল ইসলাম) মামলায় আপিল বিভাগ বলেছেন, অতীতে আন্তর্জাতিক আইন মানা হয়নি। তাই এসব মামলায়ও তাঁরা ওই সুবিধা পাবেন। এখন দ্রুত আপিল নিষ্পত্তি হলে আসামিরা মুক্তি পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারকে গত ২৭ মে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস দেন আপিল বিভাগ। ২৮ মে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। আজহারকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড ও আপিল বিভাগে ইতিপূর্বে তা বহাল রাখার রায় বাতিল করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগ তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায়ে বলেছেন, ওই মামলায় যেসব তথ্য-প্রমাণ ছিল, অতীতে আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে প্রথম খালাস পেলেন এ টি এম আজহার।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করা হয়। মামলার সংখ্যা কমে গেলে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। আওয়ামী লীগের আমলে দুই ট্রাইব্যুনাল মিলে ৫৫টি মামলার রায় দেন। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-২ দেন ১১টি রায়। এসব রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হয়। বর্তমানে ৫২ জনের আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মোবারক হোসেন ছাড়া আরও ৫১ জনের আপিল শুনানির জন্য অপেক্ষায় রয়েছে আপিল বিভাগে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মাহিদুর রহমান, ফোরকান মল্লিক, সিরাজ মাস্টার, খান আকরাম হোসেন, আতাউর রহমান, ওবায়দুল হক তাহের, শামসুদ্দিন আহম্মেদ, মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়া, মো. শামসুল হক, এস এম ইউসুফ আলী, সাখাওয়াত হোসেন, মো. আব্দুল লতিফ, ইউনুছ আহমেদ, মো. আমির আহম্মেদ ওরফে আমির আলী, মো. জয়নুল আবেদীন, মো. আব্দুল কুদ্দুস, মো. রিয়াজ উদ্দিন ফকির, মো. ইসহাক শিকদার, মো. রনজু মিয়া, আমিনুল ইমলাম, আব্দুল খালেক তালুকদার, শেখ মো. আব্দুল মজিদ প্রমুখ।

আপিল চলাকালে কয়েকজন মারা গেছেন। পরে তাঁদের আপিল অ্যাবেটেড (সমাপ্তি) ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ আদালত। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির নেতা আবদুল আলীম, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুস সুবহান, কিশোরগঞ্জের মোসলেম প্রধান, মৌলভীবাজারের রাজনগরের মো. আকমল আলী তালুকদার, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মাহবুবুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরী) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আপিল নিষ্পত্তি করে মৃত্যুদণ্ড থেকে সাজা কমে আমৃত্যু কারাদণ্ড হওয়া জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা গেছেন।

ট্রাইব্যুনালে দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেলে মুক্তি পাবেন। আর আপিলে দণ্ড বহাল থাকলে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ পাবেন। রিভিউতেও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে সব শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন না করলে বা রাষ্ট্রপতি আবেদন খারিজ করলে সরকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকটি মামলায় আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন মো. আবুল হাসান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, আপিলগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেকে দীর্ঘদিন ধরে কনডেম সেলে আছেন। তাই আপিলগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

আপিল নিষ্পত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, আপিল বিভাগে ট্রাইব্যুনালের কোনো মামলা শুনানির জন্য উঠলে প্রসিকিউশন সেখানে অংশ নেবে। আপিল নিষ্পত্তির জন্য আপিলকারী পক্ষ থেকেই বিষয়টি আদালতের নজরে আনতে হবে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে এ টি এম আজহারের মামলায় সেটেল হয়েছে কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাপ্লিকেবল হওয়া উচিত। যা আগে হয়নি। আপিল নিষ্পত্তির পর সাজা বহাল থাকতে পারে, আবার আসামি মুক্তিও পেতে পারেন। তবে যেটাই হোক, দ্রুত আপিলগুলো নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।