Image description

‘গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি যাতে বসতে না পারি। এভাবে থাকতে থাকতে আমার পা ফুলে যায়। হ্যান্ডকাফের কারণে হাত রক্তাক্ত হয়। এই যে দাগগুলো...। ওয়াশরুমে যেতে চাইলে যেতে দিত না। এর মধ্যে একদিন টেবিলের ওপরে হাত রেখে আঙুলটা প্লাস দিয়ে শক্ত করে ধরে। আরেকজন সুচ ঢুকায়।’

এভাবে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন ২০১৭ সালে একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অপহৃত হওয়া হাবিব। ২৭ বছর বয়সী এই যুবক ১১৩ দিন গুম ছিলেন। শুধু হাবিব নন, নারীরাও বাদ যাননি সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার ভয়াবহ নির্যাতনের হাত থেকে। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো বেঁচে আছেন, কেউ মারাও গেছেন। গুমের নামে নির্যাতন এবং নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা ফুটে উঠেছে অনেক ভুক্তভোগীর মুখে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম কমিশনের দাখিল করা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

অনেকের পারিবারিক জীবন যেমন- বিয়ে ও সন্তান-সম্পর্কিত বিষয়, মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারগুলো এই চাপ সহ্য করতে পারে না, ফলে ভুক্তভোগীরা এক অনিশ্চয়তা ও প্রান্তিকতার জীবনে আটকে পড়েন।

গুমের শিকারদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ কৌশল

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র‌্যাব-২ ও সিপিসি-৩ এর ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টিএফআই সেলে (র‍্যাবের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেল) মানুষ ঝুলিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত পুলি-সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক ব্যবস্থা, যা নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ না শুনতে পারে সেজন্য ব্যবহৃত হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ‘গুম’ করা হতো। তাদের আটকের কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকত না। নির্যাতিতদের জনসম্মুখে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন লুকাতে কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ওষুধ বা মলম দেওয়া হতো, যাতে ক্ষতচিহ্ন সহজে নজরে না আসে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাদের মুক্তি দেওয়া হতো। তবে এটাও সত্য যে, অনেক ভুক্তভোগী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়েছিলেন স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্নসহ। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সেসব উপেক্ষা করা হয়েছিল।

 
dhakapost
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম কমিশনের দাখিল করা প্রতিবেদন / ফাইল ছবি

সেখানে বলা হয়, গুম থেকে মুক্তি মিললেও ভুক্তভোগীর ওপর দীর্ঘ মেয়াদের প্রভাব পরিলক্ষিত হতো। তাদের মধ্যে মানসিক ট্রমার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যেত। ফলে তাদের চলমান চিকিৎসা ও মনোস্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়। অনেকের শিক্ষা ও কর্মজীবন ব্যাহত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দায়ের করা ভুয়া মামলাগুলোর আইনি লড়াইয়ের ব্যয়। প্রতিটি মামলার জন্য একজন ভুক্তভোগীর গড়ে প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অনেকের পারিবারিক জীবন যেমন- বিয়ে ও সন্তান-সম্পর্কিত বিষয়, মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারগুলো এই চাপ সহ্য করতে পারে না, ফলে ভুক্তভোগীরা এক অনিশ্চয়তা ও প্রান্তিকতার জীবনে আটকে পড়েন।

শারীরিক নির্যাতনের ভয়াবহতা

ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে বন্দিদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। সিটিটিসি কর্তৃক ২০২৩ সালে অপহৃত হন ৪৭ বছর বয়সী এক যুবক। ১৬ দিন গুম ছিলেন তিনি। তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতনকারীরা বলছে, ‘এভাবে হবে না। এরে লটকা। টানাইতে হবে।’ তো একজন এএসআই (পুলিশে সহকারী উপপরিদর্শক) বলে, হবে। সে আমার দুই হাতে রশি লাগায়। এরপর ফ্যানের হুকের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। শুধু পায়ের বুড়ো আঙুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে, পুরা শরীরটা ঝুলানো।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, গুম হওয়া ব্যক্তিরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। বমি করে দিতেন। কেউ কেউ আবার চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়ার গন্ধ পেতেন। নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেতেন না গুমের শিকার নারীরাও। তাদের ঝুলিয়ে বিকৃত উল্লাস করে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়তেন বাহিনীর সদস্যরা।

dhakapost
নারীর শরীর থেকে ওড়না সরিয়ে, গ্রিলের সঙ্গে হাত বেঁধে নির্যাতন করা হতো / ছবি- গুম কমিশন

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সম্মিলিত প্রভাবে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘ সময় ধরে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতেন। তাদের প্রায়ই প্রহরীদের অর্ধেক পরিমাণ খাবার দেওয়া হতো। হাতকড়া পরিয়ে ও চোখ বেঁধে একাকী সেলে রাখা হতো। নিজের ভাগ্যে কী আছে সেই অনিশ্চয়তার সঙ্গে সঙ্গে কঠোর এই অবস্থার সম্মিলন তৈরি করত এক ধরনের নিরবচ্ছিন্ন মানসিক চাপ। গুমের এই প্রক্রিয়া ভয় ও অপমানের একটি সংস্কৃতির সঙ্গে একত্রে কাজ করত, যেখানে শরীরের স্বাভাবিক কাজ করাও পরিণত হতো আরেক ধরনের নিপীড়নের অভিজ্ঞতায়।

নারী ভুক্তভোগীর লোমহর্ষক বর্ণনা

গুম কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ২৫ বছর বয়সী এক নারীকে পুলিশ অপহরণ করে। তিনি ২৪ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। ওই ভুক্তভোগী গুম কমিশনকে বলেন, “অনেকটা ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে। ওরা আমাদের ওড়না নিয়ে নেয়, আমার গায়ে ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, অহরহ পুরুষ মানুষরা এসে আমাদের দেখছিল। এটা বলার বাহিরে! মানে তারা একটা মজা পাচ্ছিল। বলাবলি করতেছিল যে, ‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’ আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক লেটে। কিন্তু যেই টর্চার করে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে পড়ি যে, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর উনাদেরকে বলি যে, ‘আমার তো প্যাড লাগবে’। এটা নিয়েও অনেক হাসাহাসি করে ওরা।”

dhakapost
দুই হাত বেঁধে ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে লাঠি কিংবা হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হতো ভুক্তভোগীদের / ছবি- গুম কমিশন

অভিনব পদ্ধতিতে নির্যাতন

২০১৭ সালে ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করে র‌্যাব। সেই ভুক্তভোগীকে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার জেআইসি’তে আটক রাখা হয়। যেখানে টর্চারের কারণে তার নাভির দুই পাশে আঘাতের চিহ্ন সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, ‘আমার পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মাথা নিচের দিক, পা ওপরে দিক। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন। তারপর আমাকে দুজন একসঙ্গে এলোপাথাড়ি পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরবর্তীতে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে যে, চোখের কাপড়ও খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো...। শুধু পেছনে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে। তিনি ৭২ দিন গুম ছিলেন।

নতুন নতুন কৌশলে নির্যাতন করা হতো টর্চার সেলে। প্রায়ই নখ উপড়ে ফেলা হতো সেখানে। ২০১৭ সালে র‌্যাব-১১ কর্তৃক অপহৃত হন ৫৬ বছর বয়সী এক ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, “পরে নাম জানতে পেরেছি। তখন জানতাম না। সে (আলেপ উদ্দিন) লাঠি দিয়ে খুব টর্চার করত। একদিন আমাকেও বেশ টর্চার করে। টর্চার করে আর বলে যে, ‘তাকে টাঙায় রাখ, ঝুলায় রাখ।’ সেলের গ্রিলের সঙ্গে আমাকে ঝুলায় রাখল। সঙ্গে হাতকড়া ছিল। তো এইভাবে অনেক ঘণ্টা রাখার পর আমি আর পারছিলাম না। ওইদিনের পরে যখন টর্চার করল, আঙুলের নখটা পুরা উঠে গেছিল।”

dhakapost
ভুক্তভোগীর হাত ও পা বেঁধে শরীর উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হতো / ছবি- গুম কমিশন

থাকার স্থানের ভয়াবহ ও অমানবিক অবস্থার কথা তুলে ধরেন অপর এক ভুক্তভোগী। গুম হওয়া ব্যক্তি বলেন, ‘ঘুমাতে গেলে একজন আইসা বলতেছে যে, ‘এই ঘুমাইতেছেন ক্যান?’ মানে ঘুমাইতে দিত না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পর বালিশ সরাই ফেলত। শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলত। এছাড়া চেয়ার ছাড়া (খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে) বসায় রাখত। আবার দেখা গেছে, হ্যান্ডকাপ পরায়ে বিছানার পাশে আটকে রাখত। এক হাতে মশা কামড়ালে মারা যেত না। খুব কষ্ট পাইতাম আর কী!’ তিনি ৩৯১ দিন গুম ছিলেন। তার বয়স ছিল ৪৬ বছর।

সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেখানে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। তবে, মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায় ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরে পড়ে থাকত। ফলে তারা ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেখানে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। তবে, মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায় ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরে পড়ে থাকত। ফলে তারা ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন। আরও ভয়াবহ ছিল, এসব সেলে স্থাপন করা ছিল সিসিটিভি ক্যামেরা। যার মাধ্যমে প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হতো। অর্থাৎ ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন- প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। অত্যন্ত ছোট ও সংকীর্ণ কক্ষগুলো বন্দিদের জন্য সর্বোচ্চ অস্বস্তি তৈরি করত।

dhakapost
একটি চেয়ারের সঙ্গে হাত ও পা বেঁধে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো / ছবি- গুম কমিশন

ঘূর্ণায়মান চেয়ার ও অন্যান্য কৌশল

২০১৭ সালে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাব-২ কর্তৃক অপহৃত হন ২৮ বছর বয়সী এক যুবক। তিনি ২০৮ দিন গুম ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, “একটা মেশিনে উঠাইছিল। উঠাই এইখানে (মাথায়) বাঁধছে, এইখানে (হাতে) বাঁধছে, পায়ে বাঁধছে মানে হাঁটুর মিডলে। পায়ের নিচেও বাঁধছে। এরপর ওই মেশিনটায় উঠায়। মেশিন চালানোর পরে মনে হইছে যে, আমার হাড় সম্পূর্ণ যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ওটার সেটিং এরকম যে, মেশিনটাই একটা আজব! ওরা বলতো যে, ‘তুমি পিঠ একেবারে লাগাইয়া রাখ। এখানে উঠলে কিন্তু সবাই পায়খানা করে দেয়।’ এমন কঠিন অবস্থা ছিল ওইখানে। মেশিনটা ঘোরানো যায়। কখনও কখনও উল্টা করানো যায়। আবার এরকম ফ্ল্যাট শোয়ানো যায়। ওইখানে থাকা অবস্থায় হাঁটুর উপর বাড়িও দিছে। জিজ্ঞাসা করছে, ‘তুমি সরকারের বিরুদ্ধে কী কী ষড়যন্ত্র করতেছ?”

‘হাত সম্ভবত গামছা বা কাপড় দিয়া বানছে’

২০১৯ সালে র‌্যাব-১১ কর্তৃক গুম হন ২৭ বছর বয়সী অপর এক যুবক। তিনি ৪২ দিন গুম ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, “বাইনদা, আমার এই হাঁটুর ভিতর দিয়া হাত ঢুকাইয়া, দুই হাঁটুর মাঝখান দিয়া লাঠি ঢুকাইয়া একটা উঁচু কোন স্ট্যান্ডের মধ্যে রাখছে। যেটার কারণে আমার পাগুলো উপরে ছিল। আর মাথা নিচু হয়ে গেছে। পায়ের তালুর মধ্যে এবার বাড়ি শুরু করছে। চিকন একটা লাঠি হবে সম্ভবত...। আবার ওই প্রথম থেকে একই প্রশ্ন, ‘নামগুলা বল, তোমার সাথে কে কে আছে’।”

dhakapost
বাঁশ দিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হতো ভুক্তভোগীদের / ছবি- গুম কমিশন

বাঁশ দিয়ে নির্যাতন (বাঁশডলা)

২০১৭ সালে র‌্যাব-১০ কর্তৃক ২৭ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করা হয়। তিনি ৩৯ দিন গুম ছিলেন। নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ওই যুবক বলেন, “শোয়ানোর পর আমার এই দুই হাতের উপর দিয়া আর ঘাড়ের নিচ দিয়া একটা বাঁশ দিছে। পরে পায়ের নিচ দিয়া আর রানের নিচ দিয়া একটা দিল। আবার রানের উপর দিয়াও একটা দিছে। দেওয়ার পর ওইভাবে আমাকে কিছুক্ষণ রাখল। পরে বলে যে, ‘বড় স্যার আসতেছে না।’ কিছুক্ষণ পর সে আসে। আসার পর হঠাৎ করেই বলল, ‘এই উঠ’। বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো যে, আমি আর দুনিয়ার মধ্যে নাই। এমন যন্ত্রণা আমার দুই হাতের বাহুতে শুরু হইছে, আর দুই পায়ের মধ্যে শুরু হইছে...। মনে হইতেছে কেউ আমার এই দুই হাত আর পায়ের গোস্তগুলো ছিঁড়া ফেলতেছে...।”

বৈদ্যুতিক শক

নির্যাতনের দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি ছিল বৈদ্যুতিক শক দেওয়া। সম্ভবত যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ার কারণে এর ব্যবহার এত ব্যাপক ছিল। এটি প্রায় সব স্থানেই ব্যবহৃত হতো। এমনকি অপহরণকারী যানবাহনেও। ২০১০ সালে বিশেষ গোয়েন্দা শাখা ২৯ বছর বয়সী এক যুবককে গুম করে। তার ভাষ্যমতে, ‘পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগায় দিল, ফার্স্ট সেবার শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা। যখন শক দেয়, টোটাল শরীরটা আমার ফুটবলের মতো গোল হয়ে যায়। এরকম আট থেকে দশবার আমাকে শক দিছে। শকটা হয়তো তিন-চার সেকেন্ড সর্বোচ্চ থাকে। তাৎক্ষণিক শরীরটা গোল হয়ে যায়, রগগুলো চেপে ধরে। তো ওই প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়, প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়।’

dhakapost
প্লাস দিয়ে হাতের নখ তুলে ফেলা কিংবা নখের নিচে সুচ ঢুকিয়ে নির্যাতন করা হতো / ছবি- গুম কমিশন

‘একপর্যায়ে তারা আমার কাপড় খোলে, আবার ওই একই ক্লিপ লাগায় দেয় আমার গোপন দুইটা অঙ্গে। একই জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। যখনই সুইচ দেয়, মনে হয় আমার সেই অঙ্গগুলো পুড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গোস্ত পুড়লে যেরকম একটা গন্ধ লাগে, সেই গন্ধটা পাইতাম আর কি!’ তিনি ৪৬ দিন গুম ছিলেন।

dhakapost
এমন সংকীর্ণ স্থানে রাখা হতো যেখানে দুই পা সোজা করে ঘুমানো যেত না / ছবি- গুম কমিশন 

ওয়াটারবোর্ডিং দ্বারা নির্যাতন

ওয়াটারবোর্ডিং (জলপীড়ন) দিয়ে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন এক ভুক্তভোগী। বলেন, “মুখের উপরে গামছা দিয়া উপরে দিয়া পানি মারা শুরু করে দিছে। জগভর্তি পানি দিতেছে, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাইতেছে। তারপর ওরা ওই গামছা সরাইয়া বলে, ‘বল কী করছিস’। স্যার, কী কমু..., আপনি আমারে বলেন, আমার কী জানতে চান? আপনি আমারে কেন ধইরা আনছেন?” তখন বলে, ‘না, ওরে হইত না। আবার গামছা দে, আবার গামছা দে, আবার পানি দে।’ এইভাবে তিন-চারবার পানি দেওয়ার পরে বলে, ‘ওরে নিয়া রাইখা আয়।’ তাকে ২০১৭ সালে গুম করা হয়। মোট ৩৯ দিন গুম ছিলেন তিনি।