Image description

২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে দেশজুড়ে চলছিল কোটা সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন। ঢাকার রাজপথ থেকে শুরু করে জেলা শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ঢেউ। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের আগের দিন, আন্দোলনের মুখর ৪ আগস্টে প্রশাসনের গাড়ি পিষে কেড়ে নেয় শেরপুরের তরুণ মাহবুব আলমের প্রাণ।

শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের তারাগড় কান্দাপাড়া গ্রামের মিরাজ আলী ও মোছা. মাহফুজা খাতুন দম্পতির সন্তান মাহবুব ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। মাত্র ১৯ বছর বয়সী এই তরুণ শেরপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি দুই বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র—‘আইটি ল্যাব কম্পিউটার এডুকেশন’। কাজ করতেন হার পাওয়ার ওমেন ফ্রিল্যান্সার প্রজেক্টেও।

৪ আগস্ট সকালে পরিবারের সঙ্গে খেয়ে, ভাগ্নেকে বলে যান, ‘নানিকে বলিস আমি কলেজে গেলাম।’ এটাই ছিল তার শেষ কথা। কিন্তু কলেজ আর যাওয়া হয়নি মাহবুবের। শেরপুরের খরমপুর এলাকায় ছাত্রদের মিছিলে প্রশাসনের গাড়ি উঠিয়ে দিলে মাহবুব ও আরও একজন প্রাণ হারান। আহত হন অনেকেই।

মাহবুবের বড় ভাই মাজহারুল বলেন, ‘আমার ভাই কোনো রাজনীতি করত না। কারিগরি শিক্ষার আলো ছড়াতে চাইত। বেকারদের কিছু শেখাতে চাইত। এজন্যই মিছিলটায় ছিল, অন্য কোনো দলের কারণে না। কিন্তু প্রশাসন আর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ মিলে দুই দিক থেকে হামলা করে—একদিকে গুলি, আরেকদিকে গাড়ি মিছিলে তুলে দেয়। আমার ভাই কী দোষ করেছিল?’

মাহবুবের মা মাহফুজা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। সকালে সুস্থ-সবল ছিল। কলেজে গেল, আর লাশ হয়ে ফিরল। এক বছর পেরিয়ে গেল, বিচার কিছুই পাইনি। যারা ওকে মেরে ফেলল, তারা দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। সেই ম্যাজিস্ট্রেট, যেই গাড়ি চাপা দিল, সেও এখনো চাকরিতে। আমি চাই আন্তর্জাতিক আদালতে এই হত্যার বিচার হোক। মরার আগে ন্যায়বিচার দেখে যেতে চাই।’

শুধু পরিবার নয়, পুরো শেরপুর আজও মাহবুবকে ভুলতে পারেনি। তার ছোট বোন মাবিয়া আক্তার লিবিয়া বলেন, ‘ভাই ছিল আমাদের স্বপ্ন। ভাই হারিয়ে আমরা ভেঙে পড়েছি। কিন্তু এরপরও সবাই পাশে এসেছে—জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন, কলেজ, অনেক রাজনৈতিক সংগঠন। ভাইয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমরা তৈরি করেছি ‘শহীদ মাহবুব আলম মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’। ভাইয়ের মতো কেউ যেন আর এমনভাবে না মরেন, আমরা সেই স্বপ্নেই এগিয়ে চলেছি।’

উল্লেখ্য, শেরপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বিসিএস ৪১তম ব্যাচের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম শাকিল। গত বছর ৪ আগস্ট শাকিলকে গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন চালক হারুনুর রশীদ। এ সময় ছাত্ররা শেরপুর শহরে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে আন্দোলন করতে থাকেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাকিলের নির্দেশে চালক হারুন গাড়ি দ্রুতগতিতে চালিয়ে দেন ছাত্রদের ওপর। এতে  ঘটনাস্থলে শিক্ষার্থী মাহবুব আলম ও শারদুল আশীষ সৌরভ নিহত হন। আহত হন অনেকে।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।