Image description

‘সোজা গিয়ে সামনের মোড় থেকে হাতের বাঁয়ে যাবেন। কিছুদূর এগোলেই দেখবেন একটা ভবন। রাস্তা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের ছবি দেখা যায়। ওটাই জয়গুননেসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

’ মাঝবয়সী ভদ্রলোক এভাবেই পথ দেখালেন। ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে এগোতে থাকলাম। সত্যিই রাস্তা থেকে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল ইসলামের ছবি নজর কাড়ে। দেয়ালের ওপরের অংশে আঁকা দুই কবির বেশ বড় পোর্ট্রেট।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-ft-7a.jpgস্কুলে পা রাখতেই কানে এলো কোমল কণ্ঠে গাওয়া গানটি—‘প্রজাপতি, প্রজাপতি—কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা...’। ভেতরে গিয়ে দেখি একটা রঙিন কক্ষে শিশুরা বসে আপন মনে গাইছে। তাদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন একজন নারী। গান শেষে তিনি আমাদের হাসিমুখে বললেন, ‘কার কাছে এসেছেন?’

‘আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। নিহার বানু ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ ‘আমিই নিহার বানু। একটু অপেক্ষা করুন।’

মিনিট তিনেক পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে বললেন, ‘আসুন।’ ভদ্রমহিলা এই বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষিকা।

কথায় কথায় জানালেন, ২০ বছর আগে এই স্কুলটা হয়েছে। এলাকাটি মূলত কৃষিনির্ভর। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্কুল ছিল না। দূরে বলে অভিভাবকরাও সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইতেন না। এখন সেই চিত্র বদলেছে। সবই হয়েছে সৈয়দ শাকিলের কল্যাণে।’

শুধু রাজশাহীর বাঘার এই স্কুলটি নয়, সৈয়দ শাকিলের উদ্যোগে দেশের নানা প্রান্তে এ পর্যন্ত আটটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয়করণ হয়েছে দুটি। অন্যগুলোও প্রক্রিয়াধীন। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন সাতটি। দরিদ্র-মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া, প্রান্তিক নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ, অসহায়কে চিকিৎসা সহায়তা প্রদানসহ আরো নানা সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

জার্মানি পাড়ি : মানবহিতৈষী এই মানুষটির পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মাদ শাকিল। জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন, মা গৃহিণী। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ-গানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অভিনয়ও করতেন। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাটক থাকলে অবশ্যই থাকত শাকিলের নাম। পোগোজ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।

১৯৮৬ সালে বাবা তাঁকে পাঠিয়ে দেন জার্মানিতে। সেখানে পড়াশোনা করেছেন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট বিষয়ে। পেশাজীবন শুরু করেন খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে। এখন জার্মানির নুরেমবার্গের একটি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের প্রশিক্ষক।

শিকড়কে ভোলেননি : এত বছর ধরে বিদেশে থাকলেও শিকড়কে ভোলেননি। চেষ্টা করেন দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে। এই অভ্যাসটা পেয়েছেন মা জয়গুননেসার কাছ থেকে। শৈশব থেকে শাকিল মাকে দেখেছেন সাহসী, মানবিক ও প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে, নিজের সাধ্যমতো যিনি মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দরদি এই নারী ২০০৩ সালের ১৩ জানুয়ারি চলে যান জীবন নদীর অন্য পারে।

ঢাকায় ফিরে শাকিল দেখেন, গ্রামগঞ্জ থেকেও অনেক মানুষ এসেছেন তাঁর মাকে শেষবারের মতো দেখতে। সবার একটাই কথা—‘আমাদের এখন কে দেখবে?’

কথাটা মনে দাগ কাটে শাকিলের। মায়ের অসমাপ্ত কাজ চালিয়ে নেওয়ার কথা ভাবেন তিনি।

আশার বাতি : ২০০৩ সালের ৩ জুলাই মায়ের ৬৪তম জন্মদিনে সমাজের পিছিয়ে পড়া, সুবিধাবঞ্চিত ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আশা-হোফনূং ফউন্ডেশন’।

১৮ জন জার্মান বন্ধুকে নিয়ে এই ফাউন্ডেশন গঠন করেন শাকিল। সদস্য এখন ১০৮ জন। ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আটটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সাতটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পাঁচটি উত্তরের বিভিন্ন জেলায় এবং তিনটি পার্বত্যাঞ্চলে। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ায়। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় পাঠ দেওয়া হয় সেখানে।

সৈয়দ শাকিল প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হলো রাজশাহীর বাঘার জয়গুননেসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় ভাষাসৈনিক আবুল বরকত আনন্দলোক প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাবনার সুজানগরে চর মানিকদী প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলায় দলদলী আশা-হোফনূং বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবানের আলীকদমে রেংয় পাড়া আশা-হোফনূং প্রাথমিক বিদ্যালয়, লামা উপজেলায় পোপা বদলাপাড়া আনন্দময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নওগাঁর পত্নীতলায় মাথুরাপুর সৈয়দ জামিল হাসান আনন্দময়ী বিদ্যালয়।

অবস্থান, চাহিদা, অবকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগসহ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে জানান সৈয়দ শাকিল। বিদ্যালয় চালু হওয়ার পর প্রধান শিক্ষকসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরাই এর দেখভাল করেন। প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর্যন্ত ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা প্রদান করা হয়। পরে ব্যবস্থাপনা কমিটি সার্বিক বিষয়ে তত্ত্বাবধান করে।

সৈয়দ শাকিল প্রতিষ্ঠিত প্রথম স্কুল রাজশাহীর জয়গুননেসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করেছে এটি। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠা করেছেন বান্দরবানের লামার পোপা বদলা আশা-হোফনূং আনন্দময়ী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য উথোয়াইয়ই মারমা বলেন, ‘আশপাশের অন্তত ২০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বিদ্যালয় ছিল না। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের মাথায় এই প্রথম একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পেল পোপা বাদলা পাড়ার বাসিন্দারা।’

হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ছাড়াও আরো বেশ কিছু কাজ করেন সৈয়দ শাকিল। দক্ষ নারী উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করে আশা-হোফনূং ফাউন্ডেশন। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জে পাঁচটি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এগুলোতে একেক ব্যাচে ১০ থেকে ১৫ জন নারীকে তিন মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এর মধ্যে এক হাজার নারী এই সুবিধা পেয়েছেন।

গত বছরের ডিসেম্বরে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের নাড়ুয়াগ্রামে চালু হয়েছে সর্বশেষ কেন্দ্রটি। এর পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘৩০ জন দরিদ্র নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়েছি আমরা। হতদরিদ্রদের বিনামূল্যে, অন্যদের ক্রয়মূল্যে সেলাই মেশিনও দিই।’

শিক্ষার্থীদের পাশে : ২০০৯ সাল থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাসিক বৃত্তি প্রদান করে আসছেন শাকিল। এই ফাউন্ডেশন থেকে এখন বৃত্তি পাচ্ছেন অধ্যয়নরত ১৮ জন শিক্ষার্থী। এ পর্যন্ত ৮৯ জন এই সুবিধা পেয়েছেন, যাঁদের অনেকে এখন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এঁদের একজন নড়াইলের শেখ আব্দুল্লাহ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষে এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক। তিনি বলেন, ‘আশা-হোফনূং ফাউন্ডেশনের বৃত্তি আমাকে ভরসা দিয়েছে। আমার মতো অনেকে উপকৃত হয়েছে এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। পড়ালেখার বাইরেও কোনো সমস্যায় পড়লেও পাশে দাঁড়িয়েছেন শাকিল স্যার। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’

মানুষের জন্য মন কাঁদে : শাকিল ব্যক্তিজীবনে দুই সন্তানের জনক। নিজের আয়ের একটা অংশ ব্যয় করেন সেবামূলক কাজে। জার্মানিতে বন্ধুরাও তাঁকে সাধ্যমতো সহায়তা করেন। সমাজসেবামূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বর জার্মানির নুরেমবাগ শহর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সম্মাননা পেয়েছেন শাকিল।

নিজের অবর্তমানে যেন সেবামূলক কাজগুলো চালু থাকে, এ জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ২০১৪ সালে সৈয়দ শাকিল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট গঠন করেন শাকিল। আগামী মাস থেকে এই ট্রাস্টের আওতায় দুস্থ নারীদের জন্য হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের জন্য নতুন একটা উদ্যোগ শুরু করতে যাচ্ছেন। নাম ‘স্বপ্নতরী স্বাবলম্বী প্রকল্প’।

ভবিষ্যতে শিক্ষা নিয়ে আরো বিস্তৃত পরিসরে কাজ করতে চান শাকিল। বিশেষ করে শিশু ও মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে। দেশে একটি কারিগারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছা আছে বলে জানালেন তিনি। বললেন, ‘জার্মানিতে থাকি। কিন্তু আমার শিকড় তো বাংলাদেশে। শিকড়কে ভুলে কেউ কখনো বড় হতে পারে না। মানুষের কষ্ট দেখলে আমার মন কাঁদে। তাই সাধ্যমতো পাশে থাকার চেষ্টা করি।’