
২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই। ঢাকার রাজপথ তখন জ্বলছে মেধাবঞ্চিত ছাত্র-জনতার ক্ষোভে। ‘যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ চাই’—এই স্লোগানে গর্জে উঠেছে রাজধানী থেকে জেলা শহর, শহীদ মিনার থেকে শাহবাগ। ঠিক তখনই এই ছাত্র-অভ্যুত্থানের ঢেউ এসে থেমে যায় জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার একটি গরিব ঘরের উঠোনে। আর সেই উঠোনের নাম ছিল—কোনামালঞ্চ।
এই গ্রামেরই এক কিশোর মো. সবুজ। কে জানত, ১৮ বছর বয়সেই তার কিশোর বুক চিরে গুলি যাবে? এই ছেলেটির শেষ নিঃশ্বাসও থাকবে রাজপথের বাতাসে মিশে?
সবুজের জন্ম ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, দিনমজুর মোহাম্মদ আলী ও গৃহিণী জরিনা বেগমের ঘরে। পরিবারে অভাব ছিল স্থায়ী সঙ্গী। কখনো ভাত জুটতো, কখনো জুটতো না, কিন্তু ছোট্ট ছেলেটি মায়ের মুখে একটা কথাই শুনে বড় হয়েছে—‘তুই একদিন বড় হবি, আমার বুক ফুলায়া হাঁটবি।’ সেই আশায়, নদীর কাদা মেখে, ছেঁড়া চপ্পল পরে, একখানা পুরনো বই হাতে প্রতিদিন স্কুলে ছুটে যেত সবুজ। বিদ্যুৎবিহীন রাতে কুপির আলোয় পড়ত। স্বপ্ন দেখত, পুলিশের পোশাক পরে সে একদিন দাঁড়াবে সমাজের অন্যায়ের সামনে।
জুলাই ২০২৪। ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে। সবুজ তখন ঢাকায় অবস্থান করছিল। পড়ালেখার ফাঁকে, কাজের খোঁজে, জীবনের লড়াইয়ে সে ঢাকায় এসেছিল পরিবারকে টানতে। কিন্তু মেধাবঞ্চনার সেই ক্ষোভ তার বুকেও আগুন ধরিয়েছিল। রাজপথে দাঁড়িয়েছিল সে, ব্যানার হাতে, কণ্ঠে স্লোগান—‘কোটা না মেধা, মেধা চাই, মেধার অধিকার চাই।’
২০ জুলাই বিকাল চারটা। ঢাকার বাতাস থমথমে। পুলিশি ব্যারিকেড, জলকামান, আর গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠছিল শহর। ঠিক তখনই বুকে গুলি লাগে সবুজের। লুটিয়ে পড়ে রাজপথেই। আন্দোলন থেমে যায় না, কিন্তু এক মায়ের বুকের ভেতর তখনই শুরু হয় শোকের ঝড়।
আহত অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে টানা ১৫ দিন জীবন-মৃত্যুর লড়াই চলেছে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ৫ আগস্ট রাত ৯টায় নিভে যায় সেই সংগ্রামী কিশোরের জীবন। তার বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর।
যে মায়ের মুখে প্রতিদিন শুনে বড় হয়েছিল ‘তুই পুলিশ হবি’, সেই মা জরিনা ছুটে আসেন হাসপাতালের বিছানায়। চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না, কান্নারত কন্ঠে মা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন—‘ছেলেটারে বইলা আনছিলাম, আর এক মাস চালায়া আয়। হুনলাম হাসপাতালে পড়ে আছে। যখন গেছি, তহন ডাক্তার কয়, আপনার ছেলে আইসিইউতে। তারপর? তারপর আর জ্ঞান ফেরেনি ওর…’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।