Image description
ঐকমত্য কমিশনে দেয়া এনসিপি নেতার বক্তব্য ভাইরাল

‘দেখো অনন্তকাল ঝিঁ ঝিঁ পোকার মত, আমরা কথা বলছি; অথচ কোন কথাই শেষ হয় না এখনও’ (পূর্ণেন্দু পত্রী)। কবির ওই কবিতার মতোই দিনের পর দিন চলছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক; অথচ কেউ একমত হচ্ছে না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক সংলাপ গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হচ্ছে কিন্তু সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। সংস্কার ইস্যুতে দিনের পর দিন চলা এ সংলাপের শেষ কোথায় কেউ জানেন না। এমনকি সংলাপে যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের কেউ কেউ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে নিজেদের বক্তব্য ভাইরাল করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ঢাকঢোল পেটানোর সংলাপের সফলতা কতদূর? আর কতদিন জাতিকে দেখতে হবে এই সংলাপ? প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে সে বিষয় এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনার গতকাল ছিল অষ্টম দিন। সপ্তম দিনের বৈঠকে এনসিপির এক নেতার দেয়া বক্তব্যের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিনের দেয়া ভাইরাল হওয়া বক্তব্যে শোনা যায়, ‘সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত প্রায় ৩ ঘণ্টা আলোচনা করলাম। এই সময়ে পুরো হাউস অনেক আলোচনা করল। আলোচনার এক পর্যায়ে গিয়ে আলোচনা আটকে গেল। আবার ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টা আলোচনা করলাম। এবারও আলোচনা একটা জায়গায় আটকে গেছে’। সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনায় চিত্র এনসিপি নেতার এই বক্তব্যে উঠে এসেছে? শুধু কি তাই? সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দিনের পর দিন ধরে চলা সংলাপ নিয়ে সাধারণ মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার প্রকাশ ঘটছে। এমনকি গতকাল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর ড. আলী রীয়াজকে চিঠি পাঠিয়ে সংস্কার ইস্যুতে আলোচনার জন্য গণশুনানির আহবান জানিয়েছেন। রেজিস্ট্রি ডাকযোগে পাঠানো চিঠিতে আইনজীবী বলেছেন, তিনি গভীরভাবে লক্ষ্য করছেন যে জাতীয় স্বার্থে গঠিত ঐকমত্য কমিশন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গ্রহণ করে একটি সমন্বিত সংস্কার পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবিত সংস্কারবিষয়ক আলোচনায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।এ প্রেক্ষাপটে দেশের নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, আইনজীবী সমাজ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক জনগণের মতামত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি বিস্তৃত গণশুনানি প্রক্রিয়া পরিচালনা করা জরুরি’।
বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আয়োজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ অব্যাহত রয়েছে। এ সংলাপ মাসের পর মাস ধরে চলবে নাকি সংকটের সুরাহা হবে তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক চলছে। বেরসিক নেটিজেনদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক বৈঠকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। সংলাপে অংশ নেয়া এক নেতা বলেছেন, ওই বৈঠকে আলোচনার চেয়ে খানাপিনাই বেশি হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মুফতি ফখরুল ইসলাম বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কারের নামে শুধু কালক্ষেপণই করছে না সংস্কার বলতে কোন সংস্কার হচ্ছে না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল অনেক দলকে আমন্ত্রণ জানায়নি এবং কমিশনে তাদের মতামতও নেয়নি। বর্তমানে যে সমস্ত দলের সাথে মতামতে বসেছে তাদের সাথে বিভিন্ন মতামত নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছেন না। বৈঠকের প্রায় ৮ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল এখনো তারা জাতিকে ফলপ্রসূ আশানুরূপ কোন ঐকমত্য পেশ করতে পারেননি যার কারণে দেশের জনগণ হতাশ। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের নিকট জনগণের জিজ্ঞাসা আসলেই ঐকমত্য কমিশন কি কিছু সংখ্যক দলের না সকল জনগণের। এই কমিশনের মাধ্যমে দেশের সংস্কার আদৌ হবে কিনা নাকি শেষমেশ এই ঐকমত্য কমিশন মুখ থুবড়ে পড়বে।

রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের ৮ম দিনের আলোচনার শুরুতে গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় এই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব।’ প্রশ্ন হচ্ছে সত্যিই কি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার ইস্যুতে সমঝোতায় পৌঁছতে পারবেন ঐকমত্য কমিশন? এ নিয়ে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়েছেন এমন একটি দলের নেতা জানান, ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা চলছে নিরুদ্দেশ্যেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা বলেন, ‘আমরা ছোট দল, সংলাপের আমন্ত্রণ পেয়ে অংশ নিয়েছি এতেই খুশি। তবে কমিশনের নেতাদের আচরণে মনে হয় তারা সংস্কার ইস্যুতে হয় কালক্ষেপণ করছেন; নয়তো জুলাইয়ের চেতনা ধারণ করতে পারছেন না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান থেকে ল-ন-দিল্লি হয়ে দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে না পারায় দেশের সর্বনাশ করেছিলেন। কমিশনের সদস্যদের কেউ কেউ জুলাই আন্দোলনের সময় বিদেশে ছিলেন; দেশে এসে গুরুত্বপূর্ণ পদপদবি পেলেও তারা জুলাই চেতনা ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। যার কারণে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষের মনন বুঝতে ব্যর্থ হয়ে অচেনা অজানা পিআর (সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন) নিয়ে মাতামাতি করছেন। মনে হচ্ছে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমে এরা আওয়ামী লীগকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদে নিতে চায়’।

সংলাপে অংশ নেয়া নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চাই না। বিশেষ করে নিম্নকক্ষের নির্বাচনে পিআর বাস্তবতার সঙ্গে মানায় না।’ গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ভবিষ্যতে একদলীয় শাসনব্যবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্র ও শাসনপদ্ধতিতে ভারসাম্য আনার জন্যই আমরা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করছি। যাতে করে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়েও কোনো শঙ্কা যাতে না থাকে এবং ছোট রাজনৈতিক দলগুলোও যাতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়।’

বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার ইনকিলাবকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের চলমান সংস্কার আলোচনা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হবে বলে আমরা আশা করছি। বিভিন্ন দলের মত ভিন্নতা ও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি জনিত অবস্থানের কারণে ঐকমত্য সৃষ্টির পথে কিছুটা বিলম্ব তৈরি করছে। যদি সব দলগুলো বিপুল আত্মত্যাগের জুলাই বিপ্লবের চেতনা ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ কামিতার জায়গা থেকে ক্ষমতা কেন্দ্রিক চিন্তা চেতনা পরিহার করে আলোচনা করতে পারতাম তাহলে দ্রুততার সাথে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হতো। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলসমূহের বৈঠক আজ ৮ম দিনে গড়াল। কিছু কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হলেও অনেক বিষয়ই এখনো পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়েছে। সময় যেন একটু বেশিই লেগে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের কল্যাণেই এই কার্যক্রমকে দ্রুত সমাপ্তির দিকে নেয়া দরকার।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের বিষয়ে ড. আলী রীয়াজ বলেন, কখনো কখনো আমরা অগ্রসর হই। কখনো কখনো আমরা যতটা অগ্রসর হতে চাই, ততটা না পারায় খানিকটা হতাশ হই। কিন্তু তার পরেও আমরা চেষ্টা করলে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে হয়ত একটা সনদের জায়গায় যেতে পারব। এটা আপনাদের সকলের প্রচেষ্টা, সকলের আন্তরিক সহযোগিতাটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস।