
‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’ –সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি অডিও ক্লিপে শেখ হাসিনাকে এ কথা বলতে শোনা যায়। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের শাকিল আকন্দ বুলবুল ওরফে মো. শাকিল আলমের সঙ্গে ফোনালাপে শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করা মামলার বাদী, সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবাইকে হত্যা ও তাদের বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সিআইডির ফরেনসিক বিশ্লেষণে বক্তব্যটি যে শেখ হাসিনারই, তারও প্রমাণ মেলে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার এই বক্তব্য ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন প্রক্রিয়াকে প্রেজুডিস করার অপরাধ। এ ঘটনায় গত ৩০ এপ্রিল শেখ হাসিনার কথোপকথনটি আদালতের সামনে উপস্থাপন করে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল আজ বুধবার (২ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এটি ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম কোনো সাজা।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর দল ও দেশের মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতাকে হত্যার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে চলতি বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেখ হাসিনার ওই কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে।
প্রসিকিকিউশনের ভাষ্য
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিকিউশনের ভাষ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর যেসব মামলা হয়েছে, তন্মধ্যে ট্রাইব্যুনালের মামলা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। এসব মামলাকে বাধাগ্রস্ত করতে শেখ হাসিনা বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। ভারতে বসে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। এ কারণে নেতাকর্মীদের মাধ্যমে বিচারক, প্রসিকিউটর, তদন্ত সংস্থাকে বিভিন্ন হুমকি প্রদান এবং দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তিনি।
এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার কথোপকথনের সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে আদালত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তর্কিত এই কনভারসেশনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী, সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ যারা এ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের হত্যা করা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া এবং নানাভাবে তাদের হুমকি দিয়েছেন। যেটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়াকে প্রেজুডিস করার অপরাধ।’
এ রায় কীভাবে কার্যকর হবে?
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে কী করতে পারবেন শেখ হাসিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আদালত অবমাননার মামলায় দেওয়া সাজা শেখ হাসিনা ও অপর আসামিরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ, যখন তাদের গ্রেপ্তার করা হবে তখন থেকেই এ সাজা কার্যকর করা হবে।’
গাজী এম এইচ তামিম বলেন, ‘শেখ হাসিনা যদি আত্মসমর্পন করেন বা ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তার হন, তখন তাকে কারাগারে যেতে হবে। তবে গ্রেপ্তারের পর এ সাজার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সাজা মওকুফের আবেদন করতে পারবেন। আপিল বিভাগ চাইলে সাজা বহাল রাখতে পারেন বা কমাতে পারেন। তবে কারাগারে যাওয়া ছাড়া আপিল করার সুযোগ পাবেন না শেখ হাসিনা।’
এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও গাইবান্ধার আওয়ামী লীগনেতা শাকিল আহমেদের মধ্যে কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ভাইরাল হলে গত ৩০ এপ্রিল এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চান ট্রাইব্যুনাল। তাদের হাজির হয়ে বা আইনজীবীর মাধ্যমে কথোপকথনের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল। গত ২৫ মে নির্ধারিত তারিখে তারা হাজির হননি কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমেও ব্যাখ্যা দেননি। পরে দুই আসামিকে সশরীরে হাজির হয়ে জবাব দেওয়ার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিতে নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। নির্দেশ অনুযায়ী দুটি সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এরপরও তারা হাজির হননি। আজ এ অপরাধ চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনা ও শাকিল আকন্দ বুলবুলকে দণ্ডিত করেছেন।
আদালত রায়ে বলেছেন, যেদিন তারা আত্মসমর্পণ করবেন অথবা পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে, তারপর থেকে এ সাজা কার্যকর হবে।
রায়ের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার তর্কিত যে কনভারসেশন, সেটি পুলিশের সিআইডির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তারা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়েছে, এখানে যে দুজন ব্যক্তির কনভারসেশন, তার একজন শেখ হাসিনা ও অন্যজন শাকিল আকন্দ বুলবুল। কনভারসেশনটি এআই জেনারেটেড নয়, অর্থাৎ প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হয়নি। এটি জেনুইন কনভারসেশন।