স্বাধীনতার পর থেকে পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। কোনো না কোনোভাবে প্রশাসন থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকাণ্ড সবখানেই রাজনীতির প্রভাব প্রকট।বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা বর্তমান অবস্থানে নিয়ে এসেছে পুলিশকে। ফলে, বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ও উন্নয়নের পথে রাজনৈতিক প্রভাব সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী সংশ্লিষ্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশকে এখনই সংস্কার ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা প্রয়োজন। দেশের রাজনীতিবিদরা পুলিশকে কখনও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেননি। রাজনীতিবিদরা চান না পুলিশ সংস্কার হোক। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে এবং পেশাদারত্বের সাথে কাজ করতে হবে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং উচ্চাভিলাষী মানসিকতায় পুরো বাহিনীতে তৈরি হয়েছে ইমেজ সংকট। বিগত প্রায় সাড়ে ১৬ বছরে শাসক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এসব অসাধু কর্মকর্তারা। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ক্ষোভের টার্গেট হয় পুলিশ বাহিনী। উত্তেজিত জনতা হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ চালায় পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায়। পুলিশ সদস্যদের ওপরও হামলা ও মামলার ঘটনা। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সেজন্য পুলিশকে নতুন ভাবে সাজাতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে।
রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাসীনরা সব সময় পুলিশকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় অসৎ পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে লিপ্ত থাকেন, যা পুরো বাহিনীর ইমেজ সংকটে পড়েছে। এসব সংকট মোকাবিলায় সম্প্রতি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেই বৈঠকে দাবি ওঠে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার।
পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন ছাড়া এই ইমেজ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। তাদের মতে, পুলিশ সংস্কার শুধু বাহিনীর কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বরং এটি হতে হবে মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে। পুলিশ সংস্কারের জন্য সর্বপ্রথম জরুরি হলো, রাজনৈতিক প্রভাব দূর করা। পুলিশকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে। ক্ষমতাসীনদের প্রভাব থেকে বাহিনীকে মুক্ত রাখা হলে তারা পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। পুলিশের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো এমন হতে হবে, যেখানে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তগুলো কোনো রাজনৈতিক চাপে না পড়ে।
একইসাথে, অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। এই বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ এবং মানসিকতার উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া জনগণের প্রতি পুলিশ বাহিনীর আচরণ হতে হবে সদয় এবং পেশাদার। এতে করে জনগণ আবার পুলিশকে নিজেদের রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে দেখতে শুরু করবে। রাজনৈতি পটপরিবর্তনের পর এখন পুলিশ বাহিনীর সংস্কার না হলে ফলাফল হবে মারাত্মক। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুর্নীতি, দমন-পীড়ন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর হবে। এর ফলে জনগণের ক্ষোভ বাড়বে এবং ভবিষ্যতে আরও বড় আকারের সহিংসতার আশঙ্কা থাকবে। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে পুলিশ পেশাদারত্ব দেখাতে সক্ষম হবে। এজন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পুলিশ সংস্কার ছাড়া গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, লাশের স্তূপ করেছে—এসব ঘটনায় জনমনে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়, যার কারণে পুলিশ এখন জনগণের মুখোমুখি। জনগণ ধরেই নিয়েছে, পেশাদারত্ব নয়, কোনো পক্ষের হয়ে কাজ করে পুলিশ।
তিনি বলেন, পুলিশের এই নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে অজানা আতঙ্ক ও আস্থার অভাব দেখা দেওয়ায় মাঠ পর্যায়ে সেভাবে কাজ করতে পারছে না বাহিনীটি। পাশাপাশি অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগদান করেননি বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে। অনেক জায়গায় দেখা গেছে কোনো অপরাধ ঘটলে পুলিশ সেখানে গেলে বাজে মন্তব্যের শিকার হচ্ছে এবং কাজে বাধা পাচ্ছে। এ ছাড়া থানাগুলোও আগের মতো অবস্থায় নেই। এসব ঠিক হয়ে অপরাধ দমনে পুলিশের শক্তিশালী অবস্থানে ফিরতে আরও সময় লাগবে। সবশেষ বলতে চাই, পুলিশ স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এত বড় সংকটের মুখোমুখি হয়নি, এজন্য পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে দাবি উঠেছে। যদি পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে চলতে পারে তাহলে দেশের কল্যাণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের বিষয়ে সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম জনসাধারণের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়। পাশাপাশি পুলিশও মনোবল সংকটে পড়ে। কারণ, আন্দোলনের সময় কিছু কর্মকর্তার নির্দেশ পালনে মাঠে নামতে পুলিশ বাধ্য হয়। অনেক থানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, অনেক গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, হাজার হাজার অস্ত্র লুট করা হয়, বেশ কয়েকজন পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়—সব মিলিয়ে পুলিশে আগের মনোবল ফিরতে সময় লাগবে। তবে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে পারলে পুলিশ সংস্কার হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করবে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশের উন্নতি ঘটছে। নতুন নেতৃত্বে যারা আসছেন তাদের ওপর অনেকটা নির্ভর করে পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবে কি না।
পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে রাখা না গেলে এ বাহিনীর সংস্কার কার্যক্রম স্থায়ী হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন) নেছার উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, পুলিশ জনগণের একটা অংশ। তারপরও আমরা এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ পুলিশের সেবা ছাড়া কারো চলে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক বলেন, আমরা চাই পুলিশ সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।