
১ জুলাই দিনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সাধারণত এদিন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা থাকেন উৎসবমুখর। কিন্তু গত বছর দিনটিতে শিক্ষার্থীদের মনে ছিল চাপা ক্ষোভ। কেননা ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে সর্বোচ্চ আদালত কোটা বহালের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ রায়কে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন বদলে টিএসসি এলাকায় জমায়েত হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর একটি মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে, নীলক্ষেত-সায়েন্স ল্যাব ঘুরে শাহবাগে সমাবেশে মিলিত হয়। ওই সমাবেশে ঘোষিত চার দফার মধ্যে কোটা প্রথার বাইরে সবচেয়ে জোরালো দাবি ছিল ‘দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে’।
এক বছর আগের এই দিনে তরুণ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে যে স্লোগান উঠেছিল, সেটিই পরবর্তী ৩৬ দিনে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটায়, যে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। হাত, পা, চোখ হারানোসহ আহত হয়েছেন অন্তত ২০ হাজার ছাত্র-জনতা। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে গত বছরের ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে এ তরুণ সেদিন বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দফা দাবির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এক দফাটি হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এ সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপ।’ জাতিকে আশার আলো দেখিয়ে নাহিদ ইসলামের ঘোষণা ছিল, ‘আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই, যেখানে আর কখনো কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে।’
তরুণদের নেতৃত্বে ‘মার্চ টু ঢাকা’ ও গণভবন ঘেরাও কর্মসূচির মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বছর ঘুরে আবারো ফিরে এল জুলাই। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে তরুণরা গুলির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, গত এক বছরে তার কতটা বাস্তবায়ন হলো সেটি নিয়ে খোদ আন্দোলনকারীদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে। বৈষম্য ও অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে তরুণরা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই গত এক বছরে নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন। এমনকি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী তরুণরা নানা গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্তও হয়ে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও এখনো বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা পুরনো বন্দোবস্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে আঁকড়ে থাকা ঘুস, দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রেরও অবসান হয়নি। শেখ হাসিনার দিয়ে যাওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট শেষ দিন পর্যন্ত টেনে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করেছে, সেটাও আগের সরকারের মতো গতানুগতিক বলে সমালোচনা রয়েছে। বাজেট প্রণয়নসহ অর্থনীতির নীতি কৌশল প্রণয়নে এখনো প্রাধান্য পাচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপিয়ে দেয়া শর্ত। এ শর্ত পূরণ করতে গিয়ে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বেকারত্ব, বৈষম্য ও দারিদ্র্য আরো জেঁকে বসছে। আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়ার জন্য পতিত হাসিনা সরকারই বাছবিচার ছাড়া এসব শর্ত মেনে নিয়েছিল।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের একজন আখতার হোসেন। বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব পদে থাকা এ তরুণ রাজনৈতিক নেতা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরে অর্জন আছে, তবে প্রত্যাশার এখনো অনেক বাকি। আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। নতুন রাজনৈতিক কাঠামো, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলেছিলাম। কিন্তু বৈষম্যহীন বাংলাদেশ এখনো অর্জিত হয়নি। নতুন বন্দোবস্তের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নানা সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছে। যেগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।’
আখতার হোসেন বলেন, ‘অভ্যুত্থান-পূর্ব বাংলাদেশে বিরোধী মতের রাজনীতিকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল। মানবাধিকার হরণ, গুম, খুনের মতো যে ঘটনাগুলো ঘটত, সেগুলো থেকে গত এক বছরে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। মানুষ যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি বাকস্বাধীনতা উপভোগ করছে। মোটা দাগে অর্থ পাচারের মতো ঘটনাগুলো এ সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয়নি। তবে মানুষ সরকারি অফিস-আদালতে এলে সহজে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবেন এবং সম্মানিত বোধ করবেন, এমন বাংলাদেশ এখনো তৈরি হয়নি।’
বাংলাদেশের মতোই তরুণদের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনের মুখে তিউনিসিয়া ও শ্রীলংকার কর্তৃত্ববাদী শাসকদের পতন ঘটেছিল। ২০১১ সালে জেসমিন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিউনিসিয়া ত্যাগ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবেদিন বেন আলি। ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছেড়ে ২০২২ সালে শ্রীলংকা থেকে পালিয়েছিলেন রাজাপাকসে ভাইদের মধ্যে ‘স্ট্রংম্যান’ হিসেবে পরিচিত গোতাবায়া রাজাপাকসে। আর গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন দেড় দশক ধরে বাংলাদেশ শাসন করা শেখ হাসিনা। তিনটি অভ্যুত্থানের মধ্যেই মিল হলো পতিত এ তিন সরকারই ছিল ফ্যাসিস্ট চরিত্রের। নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল নয়, তরুণদের দ্রোহের মধ্যে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এলে এসব স্বৈরশাসক দেশ ছেড়ে পালান।
তিউনিসিয়ায় অভ্যুত্থানের সময় পেরিয়েছে এক যুগেরও বেশি। এখনো অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ের অস্থিরতা থেকে বের হতে পারেনি দেশটি। আবার শ্রীলংকায় ২০২২ সালে ঘটা অভ্যুত্থানের দুই বছরের মধ্যেই শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।
গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের পতনের সময় শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ। ডলার সংকটে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও তখন ৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে। যদিও দুই বছরের মধ্যেই তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে সফলতার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর এক বড় নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীলংকা। মূল্যস্ফীতি নয়, বরং গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত টানা ১০ মাস ধরে মূল্য সংকোচনের দেখা পেয়েছে দেশটি। অর্থাৎ শ্রীলংকার বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখন কমছে। অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও শ্রীলংকা এখন বেশ স্থিতিশীল। গত মাসে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে আনুরা কুমারা দিশানায়েকের বামপন্থী জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। নির্বাচনের পর সব রাজনৈতিক দলই দেশ গড়ার কাজে যুক্ত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণ প্রজন্মও নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে।
মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে শ্রীলংকা ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও গণ-অভ্যুত্থানের পর এক যুগেও ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরোতে পারেনি তিউনিসিয়া। বিপুল গণবিক্ষোভের মুখে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি দেশটির স্বৈরশাসক জাইন আল আবেদিন বেন আলির পতন ঘটে। ২৩ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা এ স্বৈরশাসক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ আন্দোলন পরিচিতি পেয়েছিল জেসমিন রেভল্যুশন বা জেসমিন বিপ্লব নামে। আরব বসন্তের সূচনাকারী সফল এ অভ্যুত্থানের এক দশকের বেশি সময় পেরোলেও তিউনিসিয়া এখনো দিশা খুঁজে পায়নি। অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনীতিতেও স্থিতিশীলতা ফেরেনি। অর্থনৈতিক সংকোচন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ খরা, বেকারত্ব, দুর্বল রিজার্ভসহ নানামুখী চাপের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তিউনিসিয়া। বেন আলির পতনের পর এখন পর্যন্ত দেশটির শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে চারবার। কিন্তু কোনো সরকারই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এ কারণে জেসমিন বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া তিউনিসিয়ান তরুণরা দলে দলে দেশ ছেড়েছেন। দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পড়ালেখার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও তেমন সফলতা আসেনি। বিপ্লবের এক দশকের মাথায় সেখানে প্রতিবাদ বিক্ষোভও বেড়ে যায়। একই সঙ্গে তরুণদের মাঝে বেড়ে যায় আত্মহত্যার প্রবণতাও।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তিউনিসিয়ার প্রায় কাছাকাছি চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। গত ১১ মাসে শ্রীলংকার মতো সফলতার কোনো লক্ষণ দেশে দৃশ্যমান হয়নি। বরং তিউনিসিয়ার মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। প্রায় ১১ মাস হতে চললেও এখনো গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা পূরণের মতো দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। শিক্ষার্থীরা এখনো পুরোপুরি পড়ালেখার টেবিলে ফিরে যায়নি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নিয়োগ পাওয়া দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদচ্যুত হয়েছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে প্রশাসনের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছেন। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায়নি স্বাস্থ্য খাতেও।
ডলারের বাজারের স্থিতিশীলতা, রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণে ভর করে রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও দেশের অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। গত মে মাসেও দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশের বেশি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হারও এখন মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, যা মুদ্রানীতিতে ঘোষিত লক্ষ্যের তুলনায় অন্তত আড়াই শতাংশ কম। অর্থনীতির মতো বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে রাজনীতিও। জাতীয় নির্বাচন ও আগামীর রাষ্ট্রক্ষমতার ধরন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজন ক্রমশ বাড়ছে। সচিবালয়ে বিক্ষোভ, আন্দোলনের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও (এনবিআর) নজিরবিহীন বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি দেখা গেছে।
লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে খুব নগণ্য পরিমাণে ধারণ করে এগিয়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সংস্কারের জন্য ঐক্যবদ্ধ থেকে দেশের নানাবিধ সংস্কার করা অভ্যুত্থানের একটি বড় দাবি ছিল। কিন্তু দেখা গেল সরকার গঠনের পরদিন থেকেই অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো ভেঙে একে অপরের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শুরু করেছে। এটি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা অদূরভবিষ্যতেও দেখা যাচ্ছে না। বৈষম্য কমানোর যে স্পিরিট ছিল, সেটিও বাজেটসহ সরকারের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। ন্যায্য সমাজ গড়াও ছিল এ অভ্যুত্থানের অন্যতম একটি দাবি, কিন্তু সেটি হয়নি। অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও নারীরা দূরে সরে যাওয়ায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠাও হয়ে ওঠেনি। কৃষক ও শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো পদক্ষেপও নিতে দেখা যায়নি।’
পুরনো সরকারের স্টাইলেই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী বাংলাদেশ চলেছে বলে মনে করেন আলতাফ পারভেজ। তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থানের একটি বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল সচিবালয়কেন্দ্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার। কিন্তু অভ্যুত্থানের প্রধান শক্তিই সচিবালয়মুখী হয়ে গেছে, গত এক বছর সে কেন্দ্রিকই থেকে গেছে। প্রশাসনে বদলি ছাড়া কোনো ধরনের সংস্কার হয়নি। কাঠামোগত পরিবর্তন, বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের কাছে জবাবদিহি বাড়ানোর মতো কিছুই প্রশাসনে দেখা যায়নি। পুলিশ বাহিনী কিংবা আমলাতন্ত্র সংস্কারের বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা এখন আর হচ্ছে না। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো আইনও এখনো থেকে গেছে। এ আইনের ব্যবহারও আমরা এখনো দেখছি। সার্বিক বিচারে অভ্যুত্থানের চেতনায় এ সরকার চলছে বলে আমরা বলতে পারছি না। আর ভবিষ্যতের ভালো কিছুও আমি দেখি না। অভ্যুত্থান-পরবর্তী গত এক বছরে ন্যূনতম চাওয়া হলো একটি ভালো নির্বাচন। এটি হলেই ন্যূনতম সন্তুষ্টি হয়।’
অভ্যুত্থান-পরববর্তী সরকারের কাছে সবচেয়ে মৌলিক দাবি ছিল জুলাই আন্দোলনে নিহতদের তালিকা তৈরি, যথাযথ ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসা ও পুর্নবাসন। কিন্তু মৌলিক এ দাবিও এখনো পূরণ করতে পারেনি সরকার। আন্দোলনের সময় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়েও নানা মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। এ বছরের ১৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারীকৃত গেজেট অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ৮৩৪। আর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে ৮২০ জন নিহতের কথা বলা হয়েছে। যদিও বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি।
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য সচিব তারেকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, সরকারি ও বেসরকারি নানা উৎস থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে তারা ১ হাজার ৪২৩ জন শহীদের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করতে পেরেছেন। আহতের সংখ্যা সেখানে দেখানো হয় ২২ হাজারের বেশি। এ আন্দোলনে ৫৮৭ জনের অঙ্গহানি ঘটেছে, ৬৮৫ জন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, এমনকি গুলিতে ৯২ জনের দুই চোখই নষ্ট হয়ে গেছে বলেও জানানো হয়।
অবশ্য অনেক না পাওয়া সত্ত্বেও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার জন-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে চলার চেষ্টা করেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গণ-অভ্যুত্থানেরই সরকার। জন-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেই অন্তর্বর্তী সরকার চলার চেষ্টা করেছে। চলার পথে জুডিশিয়াল ক্যু, আনসার ক্যু, চারশর অধিক দাবিদাওয়া. আন্দোলনসহ নানা কারণে সে প্রচেষ্টা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আধিপত্যকামী শক্তিও ভিতর থেকে সরকারের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এত কিছুর পরও আমি মনে করি, সরকার দুই হাজার নিহত এবং ২০ হাজার আহত মানুষকে ধারণ করতে পারলে জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব।’
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও সরকারকে কয়েকটি কাজ নিশ্চিত করতে হবে। এর একটি হলো জুলাই বার্ষিকীতে জুলাই সনদ দেয়া। এছাড়া যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা এবং নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা।’
বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষ এখনো সরকারের তরফে স্বস্তির বার্তা পায়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এ নির্বাহী পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া। কিন্তু এ কাজে সরকার এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী সত্যিকার অর্থেই কষ্টে আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তার সুফল মিলছে না। তার মানে এখানে সমস্যাটি সরবরাহজনিত। সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করার পাশাপাশি চাঁদাবাজি বন্ধ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কার্যকর উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বিরাজমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট অতীতের লিগ্যাসি। কয়েক বছর ধরেই দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট চলছিল। এখন যেসব সংকট প্রকট আকারে দেখা যাচ্ছে, সেগুলো অতীতের লিগ্যাসি। ডলার সংকট, রিজার্ভের ক্ষয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ খরা, রাজস্ব ঘাটতি, সরকারের ঋণের বোঝা, ব্যাংক খাতের দুর্দশা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের লুটপাট, অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সংকটে অর্থনীতি হাবুডুবু খাচ্ছিল। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতাও শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল। এসব কারণেই জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। শ্রীলংকায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় হলেও সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে আমাদের সব প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণে এখানে সরকারের যেকোনো উদ্যোগের ফল পেতে সময় লাগবে।’