
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছবি ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপে আইডি খুলে প্রতারণা করে আসছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্র এরই মধ্যে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। যদিও এ ধরনের প্রতারণার বিষয়ে দুদক একাধিকবার বিজ্ঞপ্তি ও প্রেস ব্রিফিংয়ে সতর্ক করেছে, তবে সম্প্রতি এমন ঘটনা নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিলে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। এতে নড়েচড়ে বসে দুদকও, তাৎক্ষণিক বিবৃতিতে জানায় কড়া প্রতিবাদ। তবে সেই প্রতিবাদ নাকচ করে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় ভুক্তভোগী ও এনসিপি নেত্রী ডা. মিতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে দুদককেই দায়ী করেন।
অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) মিতুর প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে দুদক মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেন সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী, যাদের একজন নাদিক মাহমুদ আবার এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। যদিও দুদক বলছে, এ ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো কর্মকর্তা জড়িত নয়, এটি একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের কাজ।
এদিকে প্রতারণার অভিযোগে শনিবার (২৮ জুন) রাতে র্যাব, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় চারজনকে আটক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তারা হলো পিরোজপুরের বাদোলখালী (ফকিরবাড়ী) আ. ছাত্তার কবিরের ছেলে মো. সেলিম, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের মো. মজিবর রহমান শেখের ছেলে মো. তরিকুল ইসলাম, রাজধানীর মুগদার মো. আব্দুল কাশেমের ছেলে মো. আতিক ও নোয়াখালী সেনবাগ এলাকার মো. আব্দুল হাই সোহাগ। এ বিষয়ে গতকাল রোববার দুদকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. তানজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, গত ২৪ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহর একটি পোস্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয়। পোস্টটি আমলে নিয়ে ঘটনাটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পুলিশ সুপার পদমর্যাদায় কর্মরত একজন পরিচালকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে দুদক, পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় শনিবার রাতে প্রতারক চক্রটিকে শনাক্ত করে চক্রের মূলহোতা সেলিমসহ চারজন গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত একাধিক মোবাইল ফোন, ১৩টি সিমকার্ড, ব্যাংক চেক, ভিজিটিং কার্ডসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা করা হয়েছে।
জানা গেছে, এনসিপি নেত্রী ডা. মিতুর মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হওয়ার বিষয়টি সামনে এলেও এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও এ ধরনের ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। এ ধরনের প্রতারকের খপ্পরে পড়ে অন্তত চারজন দুদকে অভিযোগ জানিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই রাজধানীর বিভিন্ন থানায় জিডি করেছেন। রাজধানীর গুলশান থানায় একটি জিডিতে উদয় আহমেদ সবুজ নামের এক ভুক্তভোগী দাবি করেন, প্রতারক চক্র তার বস ইনফিনিটি এইচ সি এম লিমিটেডের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রতারণা করে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারক চক্র তার বসকে ০১৯২২-০০০৪৭৩ থেকে ফোন করে টাকা দাবি করে। জিডি নম্বর ৬২৫, তারিখ: ১০-৪-২০২৫। এ ছাড়া রমনা থানার একটি জিডিতে মো. তাজুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, তিনি সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডে কোম্পানি সচিব হিসেবে কর্মরত। তাকে দুদকের মহাপরিচালক আকতার হোসেনের পিএস পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি ফোন করে টাকা দাবি করে। এরপর বিভিন্ন কৌশলে প্রতারক চক্র কয়েক ধাপে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। রাজধানীর রমনা থানায় যার জিডি নম্বর-৯২৫, তারিখ: ১৮-৬-২৫। এই ব্যক্তিকেও একই ০১৯২২-০০০৪৭৩ নম্বর থেকে ফোন দেওয়া হয়।
এদিকে গত ২৪ জুন রাতে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ফেসবুকে তিনটি কল রেকর্ড শেয়ার করে যে পোস্টটি করেন, সেখানেও একই ফোন নম্বর যুক্ত করা হয়। সেই পোস্টে হাসনাত লেখেন, ‘আপনার নামে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ না থাকলেও সেটার ক্লিয়ারেন্স নিতে আপনাকে ১ লাখ টাকা দিতে হবে। সম্প্রতি মাহমুদা মিতুর (রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা) কাছ থেকে এই টাকা চাওয়া হয়েছে দুদকের ডিজি আকতার আর তার ডিডি পরিচয়ে। মাহমুদা মিতুকে বলা হয়, আপনি একজন ডাক্তার, আপনার তো টাকা-পয়সার অভাব থাকার কথা নয়, আপনি ১ লাখ টাকা দিয়ে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে যান। দুদকের সর্বনিম্ন রেট নাকি ১ লাখ টাকা। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আকতার আবার ফোন দিয়ে জানতে চায়, টাকা দেবে কি না? টাকা না দিলে নাকি খবর করে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
যা বলছে দুদক : বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার কথা হয় দুদকের মহাপরিচালক আকতার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুদকের পক্ষ থেকে বারবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। আমরা কিছুদিন পরপরই মিডিয়ার মাধ্যমে সবাইকে অবহিত করেছি। তবু আমরা দেখছি অনেকেই প্রতারকের ফাঁদে পড়েছেন। যারা প্রতারিত হয়েছেন তারা অনেকেই জিডি করেছেন। এমন চারটি জিডি আমাদের কাছে এসেছে। আমাদের টিম ও সংশ্লিষ্ট টিম সেগুলো নিয়ে কাজ করছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন যেটা দেখছি—সেই একই নম্বর থেকে এরই মধ্যে আরও চারটি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। এই প্রতারক চক্র যখন কথা বলে, তারা যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, তা একইরকম। আমরা আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই—এ চক্রের সঙ্গে যদি কোনোরকম কোনোভাবে দুদকের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে, কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। যারা প্রতারণা করে তারা অত্যন্ত স্মার্ট।’
তিনি বলেন, হাসনাত আব্দুল্লাহ উনার সোশ্যাল আইডিতে যে বিষয়টি তুলে এনেছেন, সে বিষয়টি নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করছি। আরও একটি বিষয় আপনাদের খোলাসা করতে চাই—বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে একটি ইনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানের পরপরই তিনি (ডা. মিতু) মনে করেছেন যে, এনফোর্সমেন্ট অভিযানে তার নাম এসেছে। তবে আমরা যখন এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করেছি সেই তথ্য যখন আমরা দিয়েছি, তখন সেখানে কখনোই তার নাম প্রকাশ করিনি। কিন্তু তিনি গণমাধ্যমে প্রিন্ট মিডিয়ায় কোথাও দেখেছেন তিনি অভিযোগে আছেন। তিনি এটা নিয়ে বারবার অভিযোগ করছিলেন। পরে সেটা তাকে বলা হয়েছে। এখন তিনি কেন এই প্রতারকের ফাঁদে পড়লেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।’
দুদক মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘যারা এখানে গণমাধ্যমে কাজ করেন তারা চাইলেই যে কোনো তথ্য ভেরিফাই করে নিতে পারেন। তবে যাচাই-বাছাই ছাড়া দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে ভেরিফাই না করে এ ধরনের তথ্য পরিবেশনে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করছি। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান যাতে বিতর্কিত না হয়, সেদিকে সবাই সহযোগিতা করবেন।’
জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের আরও একজন মহাপরিচালক বলেন, ‘হাসনাত আব্দুল্লাহর পোস্টে দুদকের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা চাই এটার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক। দুদকের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আর না থাকলে দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার জন্যও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’