
১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল বিশ্বমঞ্চে চলে আসে। হয়ে ওঠে বিশ্ব রাজনীতির এক বিতর্কিত চরিত্র। যদিও তাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও সামরিক শক্তি অনেক সময় প্রশংসিত হয়।
তবে, মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবিরোধী অনেক দেশে একটি সাধারণ মত হলো—ইসরায়েল আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি রাষ্ট্র। কিন্তু প্রক্সি রাষ্ট্র বলতে আসলে কী বোঝায়? এই দাবি কতটা সত্য? নাকি এটি শুধু একটি ধারণা?
প্রক্সি রাষ্ট্র কী
প্রক্সি রাষ্ট্র বলতে এমন একটি দেশকে বোঝানো হয়, যেটি অন্য একটি শক্তিশালী দেশের স্বার্থে কাজ করে। সাধারণত এটি ঘটে কোনো কৌশলগত এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য। এ সম্পর্ক সামরিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী দেশটি সহায়তার বিনিময়ে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করে। স্নায়ু যুদ্ধের সময় অনেক দেশ এভাবে বড় শক্তিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক
প্রক্সি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে দেখার পেছনে বড় কারণ হলো ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সম্পর্ক। এই সম্পর্কের বিভিন্ন দিক রয়েছে:
- সামরিক সহায়তা ও প্রযুক্তি: ১৯৭০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সামরিক ও কূটনৈতিক সহযোগী। এই সহযোগিতার অঙ্কও চোখে পড়ার মতো। ইসরায়েল প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা পায়। এ ছাড়া তারা একসঙ্গে উন্নত অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি তৈরি করে, যেমন আয়রন ডোম মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
- কূটনৈতিক সহায়তা: জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব এলে, যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই ভেটো ব্যবহার করে তা আটকে দেয়। এতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলের প্রতি দৃঢ় সমর্থন।
- রাজনৈতিক প্রভাব: যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসরায়েলপন্থি লবিগুলোর যেমন এআইপ্যাক-এর বড় ভূমিকা রয়েছে। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলই সাধারণত ইসরায়েলকে সমর্থন করে।
- মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত অবস্থান: মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে অস্থিরতা, স্বৈরতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধিতা রয়েছে, সেখানে ইসরায়েল একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। তারা গোয়েন্দা তথ্য দেয়, ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দেয় এবং ইরানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলায় সহায়তা করে।
শুধু অনুসারী নয়
তবে যারা ইসরায়েলকে ‘প্রক্সি’ বলার বিরোধিতা করেন, তারা বলেন এই ধারণা ইসরায়েলের নিজস্ব কৌশল ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে।
তেল আবিবের একজন বিদেশনীতি বিশ্লেষক ড. মিরিয়াম হেখট বলেন, ‘ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হাতের কাঠপুতুল নয়। এটি একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, যার নিজস্ব পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করতে চেয়েছে, তখন ইসরায়েল তা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে।’
ইসরায়েল এমন কিছু সামরিক অভিযান করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শের বিরুদ্ধে গেছে, যেমন—১৯৮১ সালে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা, অথবা সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ায় পরিচালিত অভিযান। পশ্চিম তীরে বসতি গড়ার বিষয়েও ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করে চলেছে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—ইসরায়েল এখন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে না। চীন, ভারত, রাশিয়ার মতো দেশের সঙ্গেও তারা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে কখনো কখনো উদ্বেগের কারণ হয়।
দেশের ভেতরের রাজনীতি
ইসরায়েলের সিদ্ধান্তগুলো অনেকাংশে দেশের ভেতরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল হোক বা সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা ভাবনা, বাইরের চাপ একমাত্র কারণ নয়।
জেরুজালেম ভিত্তিক সাংবাদিক ইয়ায়েল কোহেন বলেন, ‘ইসরায়েলের রাজনীতি খুবই সক্রিয়, অগোছালো এবং স্বাধীনভাবে পরিচালিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আছে ঠিকই, কিন্তু ইসরায়েলি জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো ভোট দেয় না। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্নে দুই দেশের মতপার্থক্যই তার প্রমাণ।’
সমালোচনা ও পাল্টা যুক্তি
- স্বাধীন সিদ্ধান্ত: ইসরায়েল অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন ১৯৮১ সালে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা, কিংবা পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন। এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বহুবার আপত্তি তুলেছে।
- প্রযুক্তিগত সক্ষমতা: ইসরায়েল শুধু সাহায্য গ্রহণ করে না, তারা নিজেরাই অনেক উন্নত প্রযুক্তি তৈরি করে। যেমন সাইবার নিরাপত্তা, পানি প্রযুক্তি, ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
- নিজস্ব রাজনীতি ও নিরাপত্তা ভাবনা: ইসরায়েলের নীতি তাদের নিজেদের নির্বাচনী রাজনীতি, নিরাপত্তা চেতনা এবং ইতিহাস দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে বাইরের চাপে কিছু হয় না। তাদের সামরিক ও পারমাণবিক কর্মসূচিও নিজেদের উদ্যোগেই গড়ে তোলা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপট
মধ্যপ্রাচ্যে অনেক দেশই কোনো না কোনো সময়ে প্রক্সি দেশের ভূমিকা পালন করেছে। যেমন—সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক, এমনকি হিজবুল্লাহ বা হুতি গোষ্ঠীর মতো সংগঠন। তবে ইসরায়েল ভিন্ন, কারণ একদিকে পশ্চিমাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক, আর অন্যদিকে নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা।
ইসরায়েলকে শুধু একটি প্রক্সি রাষ্ট্র বলা একটি জটিল সম্পর্ককে খুব সরল করে দেখা। হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ইসরায়েলের টিকে থাকা ও উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু ইসরায়েল কেবল যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল নয়। এটি একটি স্বাধীন দেশ, যার নিজস্ব লক্ষ্য, শক্তি ও প্রভাব রয়েছে।
বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল সম্ভবত প্রক্সি নয়। বরং এটি একটি কৌশলগত অংশীদার। অনেক সময় তাদের স্বার্থ এক হয়, আবার অনেক সময় হয় না। বিশ্ব রাজনীতি যেভাবে বদলাচ্ছে, এই সম্পর্কও তেমন বদলাবে। আর সেইসঙ্গে বদলাবে ইসরায়েলের বিশ্বে অবস্থান নিয়েও বিতর্ক।
সূত্র: টাইমস ডট কম, রয়টার্স, মাই জার্নাল কুরিয়ার