
বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই দক্ষিণাঞ্চলে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ দেখা দিয়েছে। নদী-বিধৌত এই অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রভাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নয়জন মারা গেছেন। প্রতিদিন উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে আক্রান্তের হার। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলা বরগুনাকে ডেঙ্গুর ‘হটস্পট’ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ঝালকাঠি জেলাতেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, যেখানে চলতি বছর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৬ জন।
বিশেষজ্ঞ দলটি দৈবচয়নের ভিত্তিতে পৌরসভা এলাকায় মোট ১৩৮টি বাড়ির বিভিন্ন অংশে জমে থাকা পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৪৩টি বাড়ির পানিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। অর্থাৎ বরগুনা পৌরসভার প্রায় ৫৯.৩৪ শতাংশ বাড়ির পানি ডেঙ্গু সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বিপরীতে, ইউনিয়ন পর্যায়ের ৪৬টি বাড়ির জমে থাকা পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করে ৩৫টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়
বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি : আইইডিসিআর-এর পর্যবেক্ষণ
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, ডেঙ্গু বিস্তারের কারণ শনাক্তে বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ টিম কাজ করছে। ১৭-১৯ জুন পর্যন্ত ওই জেলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী এবং অধিক সংক্রমিত এলাকা পরিদর্শন করেছে প্রতিষ্ঠানটির ছয়জন রোগতত্ত্ববিদ। সংক্রমণ ও ডেঙ্গুর ধরনের ওপর নির্ভর করে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পৃথক পৃথক তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞ দলটি দৈবচয়নের ভিত্তিতে পৌরসভা এলাকায় মোট ১৩৮টি বাড়ির বিভিন্ন অংশে জমে থাকা পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৪৩টি বাড়ির পানিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। অর্থাৎ বরগুনা পৌরসভার প্রায় ৫৯.৩৪ শতাংশ বাড়ির পানি ডেঙ্গু সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বিপরীতে, ইউনিয়ন পর্যায়ের ৪৬টি বাড়ির জমে থাকা পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করে ৩৫টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, যা শতাংশের হিসেবে প্রায় ১৬.১ শতাংশ।
নদীর তীরবর্তী এই জেলায় ডেঙ্গু অতিমারির আকার ধারণ করার কারণ জানতে চাওয়া হলে বরগুনা পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গণস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর সরেজমিন তদন্ত করেছে। তারা যেমনটি আমাদের জানিয়েছে, বাসাবাড়ির কাজের জন্য ড্রাম, পাতিল, ট্যাংকিতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখেন বাসিন্দারা। পানি জমালেও তাতে ঢাকনা দেন না। এসব পানিতে এডিস মশা ডিম দিয়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটিয়েছে।’
কারণ নিয়ে বিতর্ক: বৃষ্টি নাকি অব্যবস্থাপনা?
বরিশাল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল বলেন, ‘এডিস মশা দিনের আলোতে, বিশেষ করে ভোরবেলা এবং সন্ধ্যার আগে কামড়ায়; অন্ধকারে এই মশা কামড়ায় না। তাছাড়া স্বচ্ছ ও ডিস্টিলড ওয়াটারে (পতিত পানি) ডিম দেয়। বৃষ্টি ও ডিস্টিলড ওয়াটার অত্যন্ত স্বচ্ছ হয়। কোনো পাত্রে পাঁচদিনের বেশি স্বচ্ছ পানি জমিয়ে রাখলে তাতে ডেঙ্গু লার্ভা দিতে পারে। এর মাধ্যমে মশার বিস্তার হয়ে বাসিন্দাদের সংক্রমিত করতে পারে।’
তবে, বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখলেই যে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়বে, তা মনে করেন না বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. নীহার রঞ্জন বৈদ্য। তিনি বলেন, ‘জমে থাকা বৃষ্টির পানি গৌণ কারণ হতে পারে। তবে, বরগুনার প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি ভিন্ন। বরগুনার মানুষ যুগ যুগ ধরে বৃষ্টির পানি সুরক্ষিত পাত্রে জমিয়ে রেখে পান করে আসছেন। তখন প্রকোপ না বাড়লেও এই বছর বাড়বে কেন?’
এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমি বরগুনায় দায়িত্ব পালন করছি। বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখার বিষয়টি বারবার সামনে নিয়ে এসে প্রকৃত কারণ পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বরগুনা ডেঙ্গুর হটস্পট ঘোষণার পর পরিচ্ছন্নতা কাজে তোড়জোড় দেখি। তাছাড়া মশক নিধনে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তা কার্যকর নয়। আমি মনে করি, শহরের পরিচ্ছন্নতা ও কার্যকর ওষুধ ব্যবহার না করায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে।’
জনগণের ক্ষোভ, অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার অভিযোগ
বরগুনা সদর উপজেলার বাসিন্দা আবুল হোসেন। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, ‘পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর না থাকায় বাসিন্দাদের দেখভাল কেউ করছেন না। ৫ আগস্টের পর প্রায় এক বছর সময় পার হলো। এর মধ্যে মাত্র দুবার মশার ওষুধ দিতে দেখেছি আমি। বরগুনা শহরের মধ্যে যে খাল ও ড্রেন আছে তাও পরিষ্কার করা হয় না। ডেঙ্গু নিয়ে যখন কথাবার্তা শুরু হয়েছে, তখন দেখি পরিচ্ছন্নতা করা হচ্ছে। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। কাজ হবে কি? ততক্ষণে তো অনেক মানুষ রোগী হয়ে গেছে।’
পাশে থাকা শাহাদাৎ হোসেন নামে আরেক রোগীর স্বজন বলেন, ‘বরগুনায় ডেঙ্গু এসেছে শুধু পৌরসভার উদাসীনতায়। কোনো কাজই তারা করেনি এতদিন। বসে বসে বেতন নিয়েছে। এখন এমন এক রোগ ছড়িয়েছে যে তা কবে সমাধান হবে, কারও জানা নেই।’
তার মতে, চলতি বছর ডেঙ্গু বেশি হওয়ায় এর জীবাণু আগামী বছরও যে থাকবে না, তা নিশ্চিত হওয়া যায় কীভাবে? অথচ বরগুনা নদীর তীরের শহর। নদীর ভালো পানি শহরে ঢোকার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই।
হেনোয়ারা বেগম নামে আরেকজন বলেন, ‘আমরা তো যুগ যুগ ধইরা বৃষ্টির পানি ধইরা খাই, তহন হয় নাই কেন? এসব অজুহাত পৌরসভার। বরগুনা শহরের মধ্যের সবগুলো খালে পানি যাতায়াত করতে পারে না। পানি আটকে থাকে, ড্রেন পরিষ্কার করে না। ডোবা, নালা দেখে না পৌরসভা। এসবের পানিতেই ডেঙ্গু হয়। ৫ আগস্টের পর এক বছরে দুই-তিনবার মশার ওষুধ দিয়েছে। মেয়র-কাউন্সিলর না থাকায় শহর পরিষ্কারের খেয়াল কেউ রাখে না। আমাগো ডেঙ্গু হইবে না তো হইবে কাগো?’
সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে বরগুনা পৌরসভার প্রশাসক অনিমেষ বিশ্বাসের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।