
গাজার মানবিক সহায়তা কেন্দ্রগুলো এখন আর শুধু খাদ্য বিতরণের স্থান নয়। সেগুলো রূপ নিয়েছে মৃত্যুর ময়দানে। তাকওয়া আহমেদ আল-ওয়াওয়ি নামের গাজার একজন কবি তাঁর লেখা প্রতিবেদনে বলেছেন, এখানে প্রতিদিন যে চিত্র দেখা যায় তা যেন হাঙ্গার গেমস উপন্যাস বা সিনেমার জীবন্ত সংস্করণ।
তাঁর ভাষায়, “২০২৫ সালের মার্চ থেকে ইসরায়েল সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে রেখেছে গাজার ওপর। মানুষ এখন না খেয়ে দিন পার করছে। কেউ কেউ টানা কয়েক দিনও কিছু খেতে পারছে না।”
মে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সহায়তায় পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) সীমিত আকারে খাদ্য সহায়তা দেওয়া শুরু করে। কিন্তু সেই সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বহু ফিলিস্তিনি মৃত্যুর মুখে পড়েছেন।
জিএইচএফ কেন্দ্র: মৃত্যুর ফাঁদ
তাকওয়া জানান, তাঁর পরিবারের কেউ এই সহায়তা কেন্দ্রে যাওয়ার সাহস করেননি। কিন্তু প্রতিবেশী ও বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছেন ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার কথা।
নেতসারিম করিডোর নামে পরিচিত এই সহায়তা অঞ্চল সম্পর্কে প্রথমে ধারণা ছিল—সেখানে হয়তো শৃঙ্খলার সঙ্গে ত্রাণ দেওয়া হবে। বাস্তবে গিয়ে যারা দেখেছে, তারা ফিরে এসেছে আতঙ্ক আর শোক নিয়ে।
এই বিতরণ কেন্দ্রগুলো মূলত গাজার পূর্বাঞ্চলে সালাহউদ্দিন সড়কের পাশে অবস্থিত। চারপাশে বালুচর আর সশস্ত্র প্রহরা। ইসরায়েলি ট্যাংক ও সেনারা অবস্থান নেয় আশপাশে। কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই, কখন কেন্দ্র খোলা হবে। মানুষ সন্ধ্যা থেকে লাইন দেয়, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়।
এক সময় হঠাৎ লাউডস্পিকারে ঘোষণা আসে— “চার মিনিট! যা পাবে, নিয়ে নাও!”
কয়েকটি খাবারের বাক্স রাখা হয় বালির মধ্যে। তাও পর্যাপ্ত নয়। মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ কাউকে ধাক্কা দেয়, কেউ ছুরি বের করে। শিশু কাঁদে, নারী হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়। কেউ কেউ বাক্স পায়, অধিকাংশই পায় না।
এরপরই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। গোটা এলাকাটি রূপ নেয় রক্তাক্ত ময়দানে।
নরক থেকে ফেরা এবং যারা আর ফিরতে পারেনি
তাকওয়ার বন্ধু নূরের বাবা সুবহি ১৪ জুন নেতসারিমে খাদ্য আনতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি। কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি, ইন্টারনেটও বন্ধ ছিল। শেষে জানতে পারা যায়, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
অন্য আরেক বন্ধুর আত্মীয় খামিস ২৪ জুন সেখানে যান। তিনি কিছুটা সামনে এগোতেই ড্রোন থেকে ছোড়া গুলিতে নিহত হন। তাঁর কাঁধে ছিল পরিবারের দায়িত্ব। স্ত্রী আর এতিম ভাতিজা-ভাতিজিদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে গিয়েই প্রাণ হারান তিনি।
এই ধরনের শত শত গল্প আছে—কিন্তু সব আমাদের জানা হবে না।
গণহত্যার এক নতুন কৌশল: ক্ষুধা ও বিশৃঙ্খলা
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০০ জন ফিলিস্তিনি সহায়তা কেন্দ্রের আশেপাশে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৪ হাজার মানুষ।
তাকওয়া বলেন, এসব ঘটনাকে অনেকে ‘মানবিক সহায়তার গণহত্যা’ বলছেন, কেউ কেউ যুদ্ধাপরাধ বলে অভিহিত করেছেন। তবে তাঁর ভাষায়, "এগুলো প্রকৃত অর্থেই হাঙ্গার গেমস।"
তিনি জানান, ইচ্ছাকৃতভাবে সহায়তা কার্যক্রমকে বিশৃঙ্খল করে তোলা হচ্ছে, যাতে মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে, পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙে পড়ে এবং সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সহায়তা কার্যক্রম ছিল অনেক বেশি গোছানো। কার্ডসিস্টেমের মাধ্যমে বিধবা, এতিম, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দিয়ে সহায়তা দেওয়া হতো। কিন্তু সেই ব্যবস্থাও ইসরায়েল নিষিদ্ধ করেছে।
বিশ্ব কি এখন দেখবে?
তাকওয়ার প্রশ্ন, এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও কি বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে? ইসরায়েল ও জিএইচএফ এক মাস ধরে দাবি করে এসেছে, কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। কিন্তু পরে ইসরায়েলি গণমাধ্যমই স্বীকার করেছে, সেনাদের জনতার ওপর গুলি চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
এই সহায়তা কেন্দ্রগুলো মানবতা নয়, বরং অপমান আর মৃত্যুর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকওয়ার মতে, “হাঙ্গার গেমস এখন কল্পনা নয়, বরং বাস্তব। এবং এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা বিশ্ব নিরবতায় লালিত হচ্ছে।”
তাকওয়া আহমেদ আল-ওয়াওয়ি: গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করছেন। তিনি একজন কবি ও লেখক।
[আল জাজিরা থেকে অনুবাদ]