Image description

আদালতের নির্দেশনা মেনে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগের প্রথম ধাপে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও চালক উভয়কেই লাইসেন্সের আওতায় আনা হবে। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের তত্ত্বাবধানে ব্র্যাকের মাধ্যমে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের জন্য বিমা এবং রিকশার ফিটনেস সনদ থাকা নিয়েও আসছে বাধ্যবাধকতা।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও চালকদের ডাটাবেজ প্রস্তুত করার লক্ষ্যে ইউনিফাইড ফরম তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ‘তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন’ অনুমোদন করা হয়েছে। সেটি পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ সব সিটি কর্পোরেশনে পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশার (ই-রিকশা) টাইপ অনুমোদনের জন্য একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন অনুবিভাগ) এবং এতে বিআরটিএ, বুয়েট, বিএসটিআই, এমআইএসটি এবং ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তারা সদস্য হিসেবে আছেন। এছাড়া, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ই-রিকশা চলাচল সংক্রান্ত প্রবিধান চূড়ান্ত করার বিষয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

বাধ্যতামূলক হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন 

তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। নিবন্ধনের এই দায়িত্ব দেওয়া হবে সিটি কর্পোরেশনকে। সিটি কর্পোরেশন এটির জন্য একটি ইউনিক রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও নম্বর প্লেটও প্রদান করবে। একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুকূলে একটির বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন করা যাবে না। নিবন্ধন নবায়নের জন্য প্রতি দুই বছর অন্তর ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক হতে ইচ্ছুক হলে সেটির জন্য উপযুক্ত বৈধ বিমা নিতে পারবেন, তবে এটি নিবন্ধনের আবশ্যিক শর্ত নয়।

লাইসেন্স পেতে যেসব যোগ্যতা থাকতে হবে

একটি তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার ক্ষেত্রে চালকের লাইসেন্স প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে লাইসেন্স পেতে চালকের অবশ্যই ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর হতে হবে এবং বাংলা লিখতে ও পড়তে জানতে হবে। তাদের সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্ধারিত সরকারি হাসপাতাল হতে দৃষ্টিশক্তিসহ স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ সংগ্রহ করতে হবে। চালকদের লাইসেন্স নবায়নের জন্য ৫ বছর অন্তর চালকদের ড্রাইভিং পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। চালকগণ ট্রাফিক আইন, সড়ক নিরাপত্তা, রোড মার্কিং, ট্রাফিক সাইন ও ব্যাটারি রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্তে সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান হতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন।

গুলশানে শনিবার থেকে বন্ধ হচ্ছে ...

চালকের বিমা ও সনদ বাধ্যতামূলক

চালকের জন্য ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা নেওয়া বাধ্যতামূলক এবং এ সম্পর্কিত প্রিমিয়াম চালক বা মালিক যে কেউ পরিশোধ করতে পারবেন। বিমার কভারেজ চলমান আছে কি না তা নিরীক্ষণের জন্য সিটি কর্পোরেশন সময়কালভিত্তিক পর্যালোচনা করতে পারবে। এই বিমা সনদ নবায়নের কপি প্রতি বছর নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ বরাবর জমা দিতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিমা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণ প্রদান ও দাবি নিষ্পত্তির দায়িত্ব পালন করবে। বিমা গ্রহণ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ড চালকের লাইসেন্স ফাইলে সংযুক্ত রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মালিক ইচ্ছুক হলে নিজ বা যানবাহনের জন্য অতিরিক্ত বিমা গ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

কেমন হবে রিকশার ডিজাইন ও গতি

আকার : প্রতিটি তিন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশার সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য হবে ২৫০ সে.মি. এবং সর্বোচ্চ প্রস্থ হবে ১১০ সে.মি.।

ডিজাইন ও অনুমোদন : সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদিত স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতিটি মডেলের ই-রিকশার ডিজাইন সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন থেকে টাইপ-অনুমোদন নিতে হবে।

উৎপাদন : শুধু সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক অনুমোদিত কারখানা বা ওয়ার্কশপ নিজ ব্র্যান্ড নামে ই-রিকশা প্রস্তুত করতে পারবে।

যাত্রী ধারণক্ষমতা : চালক ব্যতীত একটি ই-রিকশা সর্বোচ্চ দুজন যাত্রী বহন করতে পারবে।

গতিসীমা : সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। স্কুলজোনে সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার। রিকশাগুলো নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করতে পারবে না এবং এর জন্য গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র সংযুক্ত থাকতে হবে।

দুর্ঘটনা ও শাস্তি : দুর্ঘটনার পর চালক পালিয়ে গেলে (হিট-অ্যান্ড-রান) তার লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল করা হবে এবং ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বাধ্যতামূলক হচ্ছে হেডলাইট, ব্রেকলাইট, হর্ন

প্রতিটি রিকশায় বৈধ এলইডি হেডলাইট, ব্রেকলাইট, রিভার্স লাইটিং, হর্ন ও লুকিং গ্লাস বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত লাইটের ব্যবহার করা যাবে না বলেও জানানো হয়েছে। রিকশায় উচ্চ দক্ষতার লিথিয়াম-আয়ন/লেড এসিড ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে। ব্যাটারিতে ফায়ার-প্রুফ কেসিং ও সঠিক ইলেকট্রিক নিরোধক (ইনসুলেশন) থাকবে। রিকশার উচ্চতা, ওজন, টার্নিং রেডিয়াস, গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স অনুমোদিত স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন গাইডলাইন অনুযায়ী হবে। রিকশায় ব্যবহার করা মোটর, চেসিস ও বডি তৈরির প্রক্রিয়া এবং সুরক্ষা ব্যবস্থাসহ সব যন্ত্রাংশ অনুমোদিত স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন গাইডলাইন অনুযায়ী মানসম্মত হবে। প্রতিটি তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইফটাইম হবে ৫ বছর। এসব স্বল্পগতির রিকশায় পর্যায়ক্রমে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম/ভেহিকেল ট্রাকিং সিস্টেম স্থাপন করার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।

ঢাকার মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা ...

সড়কে মানতে হবে যেসব নিয়ম

প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশা শুধু সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন এবং ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত রাস্তায় চলাচল করতে পারবে। কোনোভাবেই হাইওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে/এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও বাস চলাচলের সড়কে চলাচল করতে পারবে না। সিটি কর্পোরেশন ও সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন সড়কেও চলাচল করতে পারবে না। ফুটপাতে এসব রিকশা চলাচল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। চালকরা সর্বদা বাম লেনে চলাচল করবে এবং যানজট সৃষ্টি থেকে বিরত থাকবে। রিকশা চালানোরর সময় মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। ব্যবহার করলে জরিমানাযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। নির্ধারিত এলাকার বাইরে রিকশা চলাচল করবে না। দুইজনের বেশি যাত্রী বহন কিংবা অতিরিক্ত ভার বহন করা যাবে না। এছাড়া সরকারি ভবন, কূটনৈতিক এলাকা ও নিরাপত্তা সংবেদনশীল জোনে চলাচল করতে পারবে না। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ওভারটেক এবং লেন পরিবর্তন করাও যাবে না।

রুট, পার্কিং ও চার্জিং স্টেশন হবে নির্ধারিত

সিটি কর্পোরেশন ও সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ আলোচনাক্রমে ওয়ার্ড বা অঞ্চলভিত্তিক অনুমোদনযোগ্য তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা নির্ধারণ করবে। তাদের নির্ধারিত এলাকায় রুট পারমিট ব্যতীত এই রিকশা চালানো যাবে না। সিটি কর্পোরেশন সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের অটোরিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে এলাকাভিত্তিক রিকশার কালার কোড প্রচলন করবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট পার্কিং এলাকা নির্ধারণ করবে। সেখানে চার্জিং স্টেশন ও ব্যাটারি বিনিময় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। ব্যাটারি চার্জিংয়ের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তি হিসেবে সোলার চার্জিং পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে। এছাড়া সরকারি/বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহজ শর্তে ঋণদানের মাধ্যমে তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশা চালক ও মালিকদের আর্থিক সহায়তা দেবে।

পুরাতন ব্যাটারি রিসাইকেল থাকবে নিয়ন্ত্রিত 

পরিবেশ অধিদপ্তর হতে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের উদ্দেশ্যে ব্যাটারি ভাঙা বা আগুনে গলানোর কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ অটোরিকশায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্যসমূহ পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিবেশসম্মতভাবে রিসাইকেল করবে। ব্যাটারি ব্যবহারকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান (ভোক্তা বা ব্যবহারকারী, সংগ্রহকারী, আমদানিকারক, পুনঃপ্রক্রিয়াকারী, রপ্তানিকারী, উৎপাদনকারী ও অন্যান্য যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাটারির সঙ্গে সম্পৃক্ত) সব পুরাতন বা অকার্যকর ব্যাটারি নিরাপদ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে এমন ব্যাটারি রিসাইকেল কারখানা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনুমোদিত এজেন্ট, ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটরের নিকট হস্তান্তর করবে।

গুলশানে বন্ধ ব্যাটারি-চালিত রিকশা ...

ব্যাটারিচালিত রিকশা লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনা প্রসঙ্গে কথা হয় মাণ্ডা এলাকার রিকশাচালক আউয়ালের সাঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরাতো অনেক বছর ধইরা এই ব্যাটারিরিকশা চালাই, কিন্তু লাইসেন্সের কোনো নিয়ম আছিল না। এখন সরকার যে নিয়ম আনছে, এতে ভালো হইব। চালকের লাইসেন্স থাকলে পুলিশও আর ধরবো না। তবে লাইসেন্স পাইতে যেন খরচ বেশি না হয়।’ 

আরেক রিকশাচালক জাকার হোসেন বলেন, ‘এমনিতেই পুলিশের জন্য ভোগান্তিতে থাকি। আবার এইডা এলে আরও সমস্যা করতে পারে। আমরা কি আর এতসব বুঝি। তবে লাইসেন্স সহজে পাইলে ঝামেলা নাই।’

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, রিকশাচালকদের অবশ্যই জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। যদি কোথাও তাদের জবাব দিতে না হয় তাহলেতো সড়কের শৃঙ্খলা ফিরবে না। তাদের বহু আগেই লাইসেন্সের আওতায় আনা উচিত ছিল। তবে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।