
পরিবারের খাওয়ার অংশটুকু বাদে বোরো মৌসুমের উৎপাদিত ধান আর কৃষকের কাছে নেই। ধান এখন ফড়িয়া বিক্রেতা, পাইকার, মজুদকারী এবং মিলারদের কাছে। আর এতেই বাজারে শুরু হয়েছে যত অস্থিরতা, বেড়েছে ধান ও চালের দাম। এই পরিস্থিতিতে মৌসুমেও বাড়তি দামে চাল কিনতে গিয়ে চাপে পড়তে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগেও যেভাবে ধানের সব স্তরের মজুদদার ও মিল মালিকরা মিলেমিশে চালের দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে এবারও ঠিক তাই করছে। কিন্তু এবারে একেবারে দেশের সবচেয়ে বড় মৌসুমের ব্যাপক সরবরাহের মধ্যেই চালের দাম বৃদ্ধিতে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সাধারণ মানুষ চাচ্ছে যারা অবৈধভাবে ধান ও চালের দাম বাড়াচ্ছে তারা যেন শাস্তির আওতায় আসে।
ঢাকা, দিনাজপুর, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহসহ বেশ কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সপ্তাহ দুয়েক আগেও যে ধান গ্রামের হাটবাজারে বিক্রি হয়েছে মানভেদে সর্বনিম্ন ১২৫০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা মণ হিসেবে সেই ধানের দাম উঠেছে এখন ১৬০০ টাকা। অর্থাৎ মণপ্রতি ধানের দাম বেড়েছে ৩০০-৩৫০ টাকা। ধানের দাম বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে মিল মালিকরা আরও এক ধাপ এগিয়ে চালের দাম বাড়িয়েছে কেজিপ্রতি ৫-৭ টাকা পর্যন্ত। যার প্রভাব পড়েছে গ্রামের বাজার থেকে শুরু করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মুদি দোকানগুলোতে।
ঢাকার মুদি দোকানগুলোর চাল বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫০ কেজির প্রতিবস্তা চালে অন্তত ৪০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। অর্থাৎ প্রতিকেজিতে দাম বেড়েছে ৮ টাকা পর্যন্ত। যে কারণে সরকারের হিসাবেই এখন চিকন চাল কিনতে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা এবং মাঝারি মানের চিকন চাল কিনতে সর্বোচ্চ ৭২ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে ভোক্তাকে।
অথচ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, বোরো মৌসুমের মাঝারি মানের চিকন চালের (ব্রি ধান ২৮ ও ২৯) যৌক্তিক পাইকারি মূল্য ৫১ টাকা ২০ পয়সার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। যেখানে ভালো মানের চিকন চালের যৌক্তিক পাইকারি মূল্য ৬০ টাকা ৩৬ পয়সার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতার হাত ঘুরে চিকন চাল কোনো ক্ষেত্রে ২৫ টাকা এবং মাঝারি মানের চিকন চাল ১৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে এই বোরো মৌসুম, যেখানে দুই কোটি টনের বেশি চালের জোগান আসে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন ধাপের ধান ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা যেভাবে মিলেমিশে দাম বাড়ায় এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং প্রতিবছর মৌসুমের ধান ওঠার কয়েক মাস পর ধীরে ধীরে চালের দামটা বাড়ে; এবার যেখানে নতুন ধানের ব্যাপক সরবরাহের মধ্যেই দামটা বাড়তে শুরু করেছে এবং সেটা এক লাফে মানভেদে ৫-৮ টাকা পর্যন্ত কেজিপ্রতি চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতিবছর ধাপে ধাপে ১-২ টাকা করে চালের দাম বাড়লেও সেটা হতো নতুন ধান আসার কয়েক মাস পর। এবার ভরা মৌসুমেই দাম বাড়তে শুরু করেছে। ঠিক এই সময়টাতে কোনো বছর দাম বাড়ে না। ব্যবসায়ীরা শ্রমিক খরচসহ নানা অজুহাতে ধানের দাম বাড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সবসময়ই পণ্যের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারায় থাকে। চালের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ী একে অপরকে দোষারোপ করে। তবে উভয়েই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় থাকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও ব্যবসায়ীদের মানসিকতা বদলায়নি। তারা খোলস পরিবর্তন করেছে মাত্র। বাজার সিন্ডিকেট একই রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিনই ঢাকার নিত্যপণ্যের বাজার বিশ্লেষণ করে। টিসিবির হিসাবে গত বছরের ঠিক এই সময়ে সবচেয়ে ভালো মানের চিকন চালের সর্বোচ্চ দাম ছিল ৭৮ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়। অর্থাৎ প্রতিকেজিতে বাড়তি গুনতে হচ্ছে ৭ টাকা। মাঝারি মানের চিকন চালেও একই সময়ের ব্যবধানে ৭ টাকা এবং মোটা চালের কেজি ৪ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম বৃদ্ধির একই চিত্র এখন ঢাকার বাইরেও।
দিনাজপুর ধান-চালের জেলা হিসেবে পরিচিত। এই জেলায় নতুন ধান ওঠার এক মাস না পেরুতেই চালের বাজারে ঊর্ধ্বগতি। জেলার সবচেয়ে বড় পাইকারি চালের আড়ত বাহাদুরবাজার এলাকায় গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে মিনিকেট জাতের চালের ৫০ কেজির বস্তায় চালের দাম বেড়েছে ৪০০-৪৫০ টাকা। একইভাবে বিআর-২৯ ও বিআর-২৮ চালের দামও বেড়েছে। জানা গেছে, মিলগেটেও চালের দাম ৫-৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যার প্রভাবে খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতিকেজি চালের দাম বেড়েছে ৩ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত। এর বড় চাপ সবচেয়ে বেশি পড়েছে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর।
দিনাজপুর সদরের চেহেলগাজী এলাকার বশিরুল ইসলাম বলেন, মৌসুমে সাধারণত চালের দাম বাড়ে না। এবারে শুরুতেই চালের দাম যেভাবে বাড়ল সারা বছর এটা নিয়ে আমার মতো নিম্ন আয়ের মানুষকে চাপে থাকতে হবে।
ক্রেতারা বলছে, এ সময়ে চালের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। চালের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ খুঁজতে ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাজারে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
ঢাকার কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মিলগেটে চালের দাম বাড়লে আমাদের কিছু করার থাকে না। আমাদেরও বাড়াতে হয়। কিন্তু মৌসুমে প্রতিবছর যখন চালের দাম কম থাকে তখন বিক্রিও বেশি হয়। এবারে দামবৃদ্ধির কারণে বিক্রিও কমে গেছে।
মিল মালিকরা অবশ্য বরাবরের মতোই ধানের দামবৃদ্ধিকেই অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। যদিও ফড়িয়া, পাইকার, মজুদদারদের পাশাপাশি সারা দেশে বড় বড় মিল মালিকরাও ধানের একটা বড় অংশ মজুদ করে।
বাংলাদেশ মেজর, অটো ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ধানের দাম বাড়লে চালের দাম বাড়ে। ধানের দাম বাড়–ক এটা আমরা চাই, এতে করে কৃষকরা লাভবান হবে। কিন্তু বর্তমানে যে ধানের দাম বেড়েছে এতে করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে না। অধিকাংশ কৃষকের ঘরে এখন ধান নেই। এক শ্রেণির অসাধু মজুদদার ধান কিনে এখন বেশি দামে বিক্রি করছে। ফলে ধানের দাম বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে চালের দাম।’
তিনি বলেন, চালের দাম বাড়লে মিলারদের দায়ী করা হয়, আমরা চাই এটার জন্য অভিযান হোক। যারা অবৈধ মজুদ করে মিলারদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। জেলায় ছোট-বড় অনেক মজুদদার রয়েছে। তারা সবাই লাইসেন্সের আওতায় আসেনি। এসব মজুদদাররাই মূলত সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়াচ্ছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার চালের দামে লাগাম টানতে না পেরে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একবার চালের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। যদিও তখন সেটা পর্যাপ্ত মনিটরিং-এর অভাবে ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সরকার যদি জাত ও মান অনুযায়ী বিভিন্ন চালের উৎপাদন খরচ এবং সর্বোচ্চ কত টাকায় চালটা বিক্রি করা হতে পারে এ ধরনের সম্ভাব্য খরচ প্রকাশ করে এবং একইসঙ্গে বাজারে মনিটরিং জোরদার করে তাহলে হয়তো দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। তা না হলে সারা বছরই ভোক্তাকে চাল নিয়ে ভুগতে হতে পারে, যেটা ভরা মৌসুমে শুরু হলো। একইসঙ্গে এই দাম বৃদ্ধির পেছনে যে সিন্ডিকেটটি কাজ করছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যা গত সরকারের শাসনামলে দেখা যায়নি।