
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে ‘নতজানু নীতি’ থেকে সরে এসে মর্যাদাপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্য নিয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সঙ্গে চিরশ্রত্রুতা, চীনের সঙ্গে বৈরিতা, সবশেষ বাংলাদেশের ‘মাথা উঁচু’ অবস্থানে অনেক বছর পর উপমহাদেশের রাজনীতিতে হোঁচট খায় ভারত। এর মধ্যে এবার ভারতের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় বৈঠক, যাতে যোগ দেয় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। এ বৈঠকের পর ভারত সুবিধাজনক পরিবেশে বাংলাদেশের সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘সামনে এগিয়ে নেওয়ার’ জোরালো সুপারিশ উঠে এসেছে দেশটির একটি বিশেষ বৈঠকে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কংগ্রেস এমপি শশী থারুরের নেতৃত্বে দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির এক বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কমিটির সঙ্গে চার শীর্ষ বিশেষজ্ঞের দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা আলোচনা হয়। বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা, ভারতের ‘হারানো অবস্থান’ পুনরুদ্ধার করার কৌশল নিয়ে বিশদ আলোচনা হয় বলে দ্য হিন্দর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘সামনে এগিয়ে নেওয়ার’ জোরালো সুপারিশ উঠে এসেছে বৈঠকে।
সম্প্রতি চীনের কুনমিংয়ে নবম চীন-দক্ষিণ এশিয়া প্রদর্শনী এবং ষষ্ঠ চীন-দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা বৈঠকের পাশাপাশি ১৯ জুন বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান একটি অনানুষ্ঠানিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠকে তিন পক্ষ পারস্পরিক বিশ্বাস, বোঝাপড়া এবং এই অঞ্চলে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সম্ভাব্য ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে মতবিনিময় করেছেন।
বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, “চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অন্য কোনো পক্ষকে কোণঠাসা করতে নয়।”
ভারতের শুক্রবারের বিশেষ বৈঠক প্রসঙ্গে সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈঠকে ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শংকর মেনন, বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) সৈয়দ আতা হাসনাইন এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ডিন অমিতাভ মাত্তু উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সব সংসদ সদস্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সমস্যাগুলো সম্পর্কে গভীর সহমর্মিতা ও বোঝাপড়া দেখিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে। তাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মেরামত করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সত্যিকারের আগ্রহ দেখা গেছে বলেও জানিয়েছে সূত্রটি।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন । এরপর থেকেই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। শুক্রবারের বৈঠকে ভারতীয় সংসদ সদস্যরা মত দেন যে দুদেশ সাধারণ সংস্কৃতি ও ভাষার মাধ্যমে সংযুক্ত। বাংলাদেশকে ‘পাকিস্তানের মতো একটি বৈরী প্রতিবেশী’ হিসেবে দেখা উচিত নয়।
‘দুই দেশের মধ্যকার তিক্ততা কমাতে পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক কূটনীতি বা ‘সফট লঞ্চ’ শুরু করা ভারতের উচিত’ বলেও মত দেন সংসদ সদস্যরা।
এ বিষয়ে দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ‘বাংলাদেশও এই দিকে পদক্ষেপ নিয়েছে’। গত ২৩ জুন কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম. রিয়াজ হামিদুল্লাহর একটি বৈঠক হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির আলোচনা সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানায়, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ সাধারণ ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারের মাধ্যমে সংযুক্ত। এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগটি নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে জনসাধারণের অনুষ্ঠান ও যোগাযোগের মাধ্যমে ‘প্যারা-ডিপ্লোমেসি’-এর জন্য ব্যবহার করা উচিত।
বৈঠকে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব, বাংলাদেশ থেকে ভারতে ‘অবৈধ অভিবাসন’ এবং গত ১৯ জুন কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠক নিয়েও আলোচনা হয়।
এই আলোচনাগুলো ইঙ্গিত দেয়, ‘ভারতের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে এবং ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগ্রহী’-এমন ইঙ্গিত দেয় বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।
ভারতের এই বিশেষ বৈঠকের আগে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে ভারত সুবিধাজনক পরিবেশে বাংলাদেশের সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। তিনি বলেছেন, “আমরা গঙ্গাসহ একে অপরের সঙ্গে ৫৪টি নদীর পানি ভাগাভাগি করি। এসব নিয়ে আলোচনার জন্য দুই দেশের যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) রয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান ও চীনসহ ত্রিদেশীয় বৈঠকে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ভারতীয় মুখপাত্র বলেন, “ভারত তার স্বার্থ ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন আঞ্চলিক ঘটনাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।”
“অন্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাধীন হলেও তা আঞ্চলিক পরিস্থিতির কারণে প্রভাবিত হয়”-যোগ করেন জয়সওয়াল।