
সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের বেলগাছি রেলওয়ে স্টেশন। একসময় মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ থাকতো। রাতে আলো জ্বলত, বাজতো ঘণ্টা, কুলির হাঁকাহাঁকিতে জেগে থাকত স্টেশন। এখন আর আগের মতো নেই। বেলগাছি রেলওয়ে স্টেশন এখন অযত্ন-অবহেলায় জরাজীর্ণ।
ইতিহাস বলছে, ১৮৭১ সালে ১জানুয়ারি কুষ্টিয়া থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত ৭৫ কিমি রেললাইন উদ্বোধন করে ব্রিটিশ সরকার। ওই সময় কুষ্টিয়া থেকে গোয়ালন্দ ঘাট লাইনের স্টেশন হিসেবে বেলগাছি রেলস্টেশনও উদ্বোধন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে স্টেশনটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে স্টেশনটি আজ তার জৌলুশ হারিয়েছে।
অবহেলা, অযত্ন আর সংস্কারের অভাবে স্টেশনটি পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দেড়শ বছর আগের এই রেলস্টেশনটি এখন শুধুই ইতিহাস। ২০০৮ সালে স্টেশনটির সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার পর চুরি হয়ে গেছে স্টেশনের অনেক যন্ত্রাংশ।
সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে নেই স্টেশন মাস্টার, নেই টিকিট বিক্রি। এমনকি নেই কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী। ট্রেন আসার আগে ঘণ্টা দেওয়া হতো, সেটিও চুরি হয়ে গেছে। লাল ইটের দালানগুলোতে ঘাস আর ছোট ছোট আগাছায় ভরে গেছে, বিভিন্ন স্থানে ধরেছে ফাটল। দালানের রুমগুলোতে ঝুলছে তালা। একটি রুমের দরজা ভাঙা। সেই রুমেও ভাঙা দু’টি বসার স্থান রয়েছে। সেখানেও পানিতে ভরা। এতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এই স্টেশনের যাত্রীদের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্টেশনে বসার জায়গা নেই। লাইট ছিল না, স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে কিছু লাইট লাগানো হয়েছে। পানি নেই, শৌচাগার নেই। বৃষ্টি হলে দাঁড়ানোর মতো জায়গারও অভাব। গরমে অনেক কষ্ট করে থাকতে হয়। এই স্টেশন দিয়ে ঢাকাগামী নকশীকাঁথা (লোকাল) এবং তিনটি আন্তঃনগর (সুন্দরবন এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেস ও মধুমতী এক্সপ্রেস) চলাচল করে। এখানে ঢাকাগামী লোকাল ট্রেন ও দু’টি অন্য লোকালও থামে। তবে কোনো আন্তঃনগর ট্রেন থামে না । এই স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশ’ যাত্রী ওঠানামা করে। কিন্তু তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় প্রতিদিন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, কালের বিবর্তনে দেশের অনেক রেলস্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই বেলগাছি রেলস্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে দখল হয়ে গেছে রেলের অনেক জমিও। বেলগাছি স্টেশনটি পুনরায় চালু ও একটি আধুনিক স্টেশন নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের। এই দাবিতে গত ১৬ জুন বেলগাছির সর্বস্তরের জনগণ রেলওয়ে স্টেশন পুনরায় চালু ও পুণর্নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন করে।
ওই এলাকার শিক্ষার্থী আসমা খাতুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেলগাছি রেলস্টেশনে বসার জায়গা নেই, ওয়াশরুম নেই। অন্যান্য স্টেশনে সব রয়েছে, আমাদের স্টেশনে নেই।’ ভাটিয়াপাড়া ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বোয়ালমারীগামী যাত্রী রহিম মোল্লা। সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে তিনি বলেন, ‘আসছিলাম আত্নাীয় বাড়ি বেড়াতে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি, ট্রেন কখন আসবে কেও বলতে পারে না। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বৃষ্টি এসেছে। দৌড়ে পাশের একটি দোকানে গিয়েছিলাম।’
স্থানীয় যুবক মাহাদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘একসময় এই বেলগাছি স্টেশন জাঁকজমক ছিল। বেলগাছির গুড় বিখ্যাত। বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা ট্রেনে এসে এখান থেকে গুড় কিনে আবার অন্য ট্রেনে ফিরে যেতেন। এখন এই বেলগাছি স্টেশন অবহেলিত। যাত্রীদের বসার জায়গা নেই, পানির ব্যবস্থা নেই, ওয়াশরুম নেই। বৃষ্টি হচ্ছে, যাত্রীরা বিভিন্ন দোকানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা চাই, এই স্টেশন আগের মতো চালু হোক। এটি একটি আধুনিক রেলস্টেশন করা হোক।’
চন্দনী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষকদলের সদস্য সচিব এ কে এম সিরাজুল আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৮৭১ সালে ব্রিটিশ সরকার এই স্টেশন চালু করে। স্টেশনের পাশে রয়েছে নাজিরগঞ্জ ঘাট। এই স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন স্থানের লোক চলাচল করে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা চলাচল করতেন এখান দিয়ে। ব্যবসার অন্যতম স্থান ছিল এই বেলগাছি। এখন বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। স্টেশনটি একদমই জরাজীর্ণ। নেই স্টেশন মাস্টার, নেই কোনো কর্মকর্তা। আমরা চাই, স্টেশনটি পুনরায় চালু হোক।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজবাড়ীর সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেলগাছি স্টেশনের কার্যক্রম অনেক বছর বন্ধ রয়েছে। চালুর দাবিতে এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি। এ ছাড়া, এলকাবাসীও জানিয়েছে। আমরা বেলগাছি স্টেশন পুনরায় চালুর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নজরে নিয়ে আসব। এবং এলাকাবাসীর দাবি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দেব।’
সারাবাংলা