Image description

“এই চনপাড়ার ইতিহাসই এমন। এইখানে ভালো মানুষ কেউ থাকে না। কেউ একটু টাকা-পয়সা কামাইতে পারলেই এলাকা ছাইড়া চইলা যায় অন্য জায়গায়। যারা তারপরও থাকে, তাগো অন্য স্বার্থ আছে।”

কথাগুলো বলছিলেন স্থানীয় মুদি দোকানি মো. সোহেল। তার ভাষায়, টাকাপয়সার মালিক হতে না পারায় তাকে চনপাড়াতেই থেকে যেতে হয়েছে, দেখতে হয়েছে অনেক কিছু।

‘চনপাড়া’ নারায়ণগঞ্জের একটি ওয়ার্ড, কিন্তু মাদক কারবারি আর অপরাধীদের কাছে এ যেন রীতিমত এক রাজ্য, যার নিয়ন্ত্রণ নিতে সব পক্ষই মরিয়া।

রাজধানীর অদূরে তিন দিক দিয়ে নদ-নদী বেষ্টিত এই ছোট্ট ভূখণ্ড এমন বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে। গতবছর অগাস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আগে যেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল, সেখানে এখন বিএনপির লোকজন বসেছে। এই সময়ে কিছু ‘লোক দেখানো’ প্রকাশ্য পরিবর্তন হয়েছে বটে, তবে মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে খুন-গুম-চাঁদাবাজি-দ্বন্দ্ব যথারীতি অব্যাহত থাকায় ‘ভয়-ভীতি আর আতঙ্ক’ আগের মতই আছে।

অগাস্টে নতুন লোকজন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দশ মাসে ‘অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে’ চারটি খুন হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার এসব ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদেরও আওয়ামী লীগের লোকজনের মত চনপাড়া ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে; অথবা তারা ভয়ে আর চনপাড়ার পথ মাড়াচ্ছেন না।

চনপাড়ার এসব অলি-গলিতে আগে প্রকাশ্যে মাদকের বেচাকেনা হলেও এখন তা কমে এসেছে বলে স্থানীয়দের বলতে শোনা গেছে।

চনপাড়ার এসব অলি-গলিতে আগে প্রকাশ্যে মাদকের বেচাকেনা হলেও এখন তা কমে এসেছে বলে স্থানীয়দের বলতে শোনা গেছে।

চনপাড়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গত সপ্তাহে বেশ কিছু সময় ধরে কথা হয় মুদি দোকানি সোহেলের সঙ্গে। তিনি চনপাড়ার অনেক ঘটনার সাক্ষী।

সোহেল বলছিলেন, “চনপাড়ায় আগে রাস্তাঘাটে মাদক বিক্রি চলত। কাউরেই কেউ পরোয়া করত না। এইটা এখন কমছে সত্য। কিন্তু বাকি যেইসব কাজ, যেমন এরে-ওরে ধইরা আইনা মাইর দেওয়া, টাকা আদায় করা- এইগুলা আগের মতই আছে। আগেও যেমন বুক ফুলায়ে কিছু বলা যাইত না, এখনও তাই। কোনোকিছু পাল্টায় নাই। পাল্টাইছে খালি সামনের মুখগুলা।”

তবে চনপাড়ার মানুষ এখন ‘কিছুটা স্বস্তিতে আছে’ মন্তব্য করে এ দোকানি বলেন, “এখন তো প্রশাসন কারও পক্ষে না। অনেকেই প্রশাসনের ভয়ে চুপ। সামনে নির্বাচন। দলীয় সরকার আসলে পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকে যাইতে পারে।”

রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলীর দাবি, আগস্টের পর চনপাড়ার মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম অনেক কমে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা এতে জোরালো ভূমিকা রেখেছে।

“চনপাড়ার ইতিহাসে এমনটা কখনও হয় নাই। এই পরিবর্তন ধরে রাখতে হবে। পুলিশের অবস্থান এখানে শক্ত। তাই কোনো রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে না।”

ওসি এমনটা দাবি করলেও তার থানাতেই আগস্টের পর থেকে গত কয়েক মাসে গড়ে অন্তত ১৫টি মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে; যার সঙ্গে চনপাড়ার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

ছোট ছোট গলি আর ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে এখানে অভিযান চালানোও খুব কঠিন বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। 

ছোট ছোট গলি আর ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে এখানে অভিযান চালানোও খুব কঠিন বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। 

পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে অপরাধের ‘স্বর্গরাজ্য’

রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া এক সময় ছিল ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) ১২৬ একর জমির ওপর দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়িঘর হারানো আশ্রয়হীন মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। নাম দেওয়া হয় ‘চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র’।

শুরুতে সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবারের পুনর্বাসন হলেও বর্তমানে চনপাড়ার বাসিন্দা লক্ষাধিক। ভোটার রয়েছেন প্রায় ২২ হাজার। ভোটার হালনাগাদের সবশেষ তালিকা ধরলে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, চনপাড়ার ভাসমান লোকজন শুরুতে দিনমজুরের কাজ করতেন। তবে আশির দশকের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে মাদক কেনাবেচা শুরু হয়। একাধিক ‘বাহিনী’ মাদক বেচা-কেনার পাশাপাশি চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে।

 প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি ও ব্যবহার অনেকটা কমে গেলেও চনপাড়ায় এখনো ‘হোম সার্ভিস’ চালু আছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। 

প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি ও ব্যবহার অনেকটা কমে গেলেও চনপাড়ায় এখনো ‘হোম সার্ভিস’ চালু আছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। 

গত কয়েক বছরে ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়’ মাদক চোরাকারবারি ও অপরাধীদের ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হয়েছে এ এলাকা।

চনপাড়া গ্রামে স্থলপথে ঢোকার একমাত্র পথ ডেমরা থেকে বালু সেতু হয়ে। সেতু পার হলেই চনপাড়া মোড়। চনপাড়াকে নয়টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের অসংখ্য অলিগলি। বাড়িঘর একটার সঙ্গে অন্যটা লাগোয়া।

চনপাড়ার দুই দিকে শীতলক্ষ্যা নদী এবং একদিকে বালু নদ। পাশের ডেমরা, নোয়াপাড়া ও মুড়াপাড়া থেকে নদীপথে চনপাড়ায় ঢোকা যায়। রয়েছে একাধিক খেয়াঘাট।

স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ জানায়, বেশিরভাগ মাদকের চালান চনপাড়ায় ঢোকে জলপথে। স্থলপথেও অভিনব কায়দায় মাদকের ছোট-বড় চালান আনা হয়। অস্ত্র কেনা-বেচাও চলে এখানে। এমনকি অপরাধীদের কাছে আত্মগোপনে থাকার জায়গা হিসেবেও চনপাড়া গুরুত্বপূর্ণ।

ছোট্ট চনপাড়াকে নয়টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের অসংখ্য অলিগলি। বলা হয়ে থাকে, এখানে অলিগলির চেয়ে ‘মাদকের স্পট’ বেশি।

ছোট্ট চনপাড়াকে নয়টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের অসংখ্য অলিগলি। বলা হয়ে থাকে, এখানে অলিগলির চেয়ে ‘মাদকের স্পট’ বেশি।

‘ডন’ আসে ‘ডন’ যায়

স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় চনপাড়া ছিল সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার ওরফে কুট্টির নিয়ন্ত্রণে। আধিপত্যের লড়াইয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিউটির স্বামী এম এ হাসান ওরফে হাসান মুহুরি খুন হন। তার দুই বছরের মাথায় ২০১৯ সালের জুনে খুন হন বিউটিও।

বিউটি খুন হওয়ার পর চনপাড়া মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য, প্যানেল চেয়ারম্যান বজলুর রহমান। তিনি সবসময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতেন। একসময় তিনি হয়ে উঠেন চনপাড়ার ‘ডন’।

২০২২ সালে বুয়েটের ছাত্র ফারদিন নূর পরশের মৃত্যুতে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র সারাদেশে আলোচনায় আসে। ওই সময় পুলিশ জানায়, বুয়েটের এ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার আগে তার মোবাইল ফোনের সর্বশেষ অবস্থান ছিল চনপাড়া।

ওই বছরের ১০ নভেম্বর র‌্যাবের সঙ্গে কথিত এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে ‘সিটি শাহীন’। তিনি বজলুর অনুসারী ছিলেন। চনপাড়ার বেশ কয়েকটি মাদকের স্পট নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।

মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে চনপাড়ায় খুন-গুম-চাঁদাবাজি-দ্বন্দ্ব যথারীতি অব্যাহত থাকায় ‘ভয়-ভীতি আর আতঙ্ক’ আগের মতই আছে।

মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে চনপাড়ায় খুন-গুম-চাঁদাবাজি-দ্বন্দ্ব যথারীতি অব্যাহত থাকায় ‘ভয়-ভীতি আর আতঙ্ক’ আগের মতই আছে।

‘সিটি শাহীনের’ মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর ১৮ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন বজলুর রহমান। তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার অভিযোগসহ অন্তত ২৬টি মামলা ছিল। পরের বছর ৩১ মার্চ কারা হেফাজতে ‘অসুস্থ’ হয়ে মারা যান তিনি।

বজলুর মৃত্যুর পর আলোচনায় আসেন সমসের আলী। সেখানে উপ-নির্বাচন দেয় নির্বাচন কমিশন। সমসের তখন ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। বজলুরের অবর্তমানে চনপাড়ার মাদক ব্যবসা ও অপরাধ জগতের দখল চলে যায় চনপাড়া ইউনিয়ন (সাংগঠনিক ইউনিয়ন) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) সমসেরের হাতে।

৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত একটি হত্যা মামলায় সমসেরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

বজলুর রহমান, রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে ‘সিটি শাহীন’ ও সমসের আলী- তিনজনই আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর অনুসারী ছিলেন। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠতার কারণে স্থানীয়ভাবে তারা আলাদা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন।

খুনের পর খুন

আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর সাত মাসে চনপাড়ায় চারটি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

৫ অগাস্ট সন্ধ্যায় একটি আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সশস্ত্র হামলার অভিযোগ ওঠে।

হামলায় দশম শ্রেণির ছাত্র রোমান মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। রোমান চনপাড়ার নবকিশলয় উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল।

পরদিন ৬ অগাস্ট রাতে নিখোঁজ হন মো. সৌরভ (২৬) ও সজীব হাওলাদার (২৮) নামে দুই বন্ধু। তিন দিন পর ৯ অগাস্ট চনপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শীতলক্ষ্যা নদীর অফিস ঘাট থেকে সৌরভের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। স্বজনরা জানান, সেই মরদেহ ছিল বিভৎস।

আট দিন পর ১৪ অগাস্ট দুপুরে সজীবের মরদেহের সন্ধান মেলে কয়েক কিলোমিটার দূরে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া এলাকার নদীতে।

চনপাড়ার মূল বাজারের একটি গলি। দুপুর দিকে কিছুটা নিরব থাকে। 

চনপাড়ার মূল বাজারের একটি গলি। দুপুর দিকে কিছুটা নিরব থাকে। 

তাদের স্বজনরা বলছিলেন, সৌরভ নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় একটি যাত্রী পরিবহনের কাউন্টারে টিকেট বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। আর সজীব চনপাড়ার অদূরে ডেমরা মীরপাড়া এলাকায় ‘ভেলপুড়ি’ বিক্রি করতেন। ঘটনার দিন দুই বন্ধু একসঙ্গেই চনপাড়াতে গিয়েছিলেন।

ওই সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক থাকায় দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাতেই পরিবারের সদস্যরা থানায় না গিয়ে আদালতে মামলা করেন। একটির বাদী সৌরভের স্ত্রী বৃষ্টি আক্তার এবং অন্যটির সজীবের স্ত্রী রাবেয়া বেগম।

তবে এখন ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে তারা খুব একটা আগ্রহী নন। এর পেছনে ‘ভয়ের’ কথাও স্বীকার করেছেন তারা। দুই মামলার বাদীই ঘটনার পর থেকে আর চনপাড়া যাননি। দুজনেই থাকেন অন্য এলাকায় বাবার বাড়িতে।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, চনপাড়ার অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে সজীব ও সৌরভের সখ্যতা ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে দলটির নেতাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সহযোগীদের দিয়ে মাদক ব্যবসার বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন জয়নাল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জয়নালের সঙ্গে সখ্যতাকে কেন্দ্র করেই প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়ে থাকতে পারেন সৌরভ ও সজীব।

সবশেষ ১৮ মার্চ রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চনপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. হাসিব (২৮)। ওই সংঘর্ষে আরও দুজন গুলিবিদ্ধ হন।

স্বজনরা জানান, ওই রাতে রবিন নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেন চনপাড়া সাংগঠনিক ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মনির দেওয়ানের অনুসারীরা। পরে তাকে স্থানীয় যুবদল কার্যালয়ে নেওয়া হয়।

কিন্তু তাকে ছাড়িয়ে নিতে সেখানে যান ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল করিম এবং ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি গোলাম রাব্বানী। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে তা সংঘর্ষের রূপ নেয়।

নিহত হাসিবের ভাই মো. বাবু এ ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় করিম, রাব্বানী ও তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শাকিলসহ ১৭ জনের নাম বলা হয়েছে।

মামলার বাদী বাবু নিজেকে যুবদল কর্মী বলে পরিচয় দেন। তিনি স্থানীয়ভাবে শামীম মিয়ার ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে পরিচিত।

ওই ঘটনায় রবিনকে অপহরণের অভিযোগে আদালতে আরেকটি মামলা হয়। ওই মামলায় শামীম মিয়া, হাসিবের ভাই বাবুসহ তাদের ঘনিষ্ঠজনদের আসামি করা হয়।

ওই সংঘর্ষের ঘটনার পর র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক বিশেষ অভিযান চলে। পাল্টাপাল্টি মামলায় উভয়পক্ষের লোকজন আসামি হওয়ায় দুই পক্ষই বেকায়দায় পড়ে। করিম, রাব্বানী ও শাকিল গ্রেপ্তার হয়ে এখন জেলে আছেন।

‘চোখ ছিল উপড়ানো, পেছনে ক্রিকেট স্ট্যাম্প’

সৌরভ যখন খুন হন, তখন তার স্ত্রী বৃষ্টি আক্তার ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর বিভৎস মরদেহ দেখেই তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, কী ঘটেছে আর কী ঘটতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি চনপাড়ার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যান।

১ জুন সৌরভের পরিবারের খোঁজে গিয়ে চনপাড়ায় আর কাউকে পাওয়া যায়নি। ভয়েই তারা আর এমুখো হননি।

পরে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় সৌরভের স্ত্রী বৃষ্টি আক্তারের ফুফু মর্জিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, “সৌরভ যে রাতে নিখোঁজ হয় ওইদিন আমার বাড়িতেই আসছিল। মাঝে-মাঝেই আসত। ওইদিন খাওয়া-দাওয়া করল, তারপর রাত থেইকাই নিখোঁজ।

 

বৃষ্টিস্নাত এক দুপুরে বাজার দিয়ে ঘরে ফিরছেন চনপাড়ার বাসিন্দারা।

বৃষ্টিস্নাত এক দুপুরে বাজার দিয়ে ঘরে ফিরছেন চনপাড়ার বাসিন্দারা।

“ওর যেই লাশটা দেখছি, ওইটা দেখার পর অনেক রাত আমি ঘুমাইতে পারি নাই। চোখ ছিল পুরা ওঠানো, পেছন দিয়া ক্রিকেটের স্ট্যাম্প ঢুকিয়ে দিছিল। আমি জীবনে এমন মৃত্যু দেখি নাই।”

মধ্যবয়সী এ নারী বলছিলেন, “এই এলাকা কোনোকালেই ভালো ছিল না। আগেও যেমন ছিল, এখনও তাই। এলাকায় থাকি না ভয়ে। থাকলেও কারও বিরুদ্ধে কিছু বলা যাইব না। আমার ভাতিজিরে মামলা তুইল্লা নিতে হুমকিও দিছে। কিন্তু ওয় মামলা তুলব না কইছে।”

মর্জিনার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি এক ফাঁকে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলেন, গণমাধ্যমে কথা বলার কারণে ‘কোনো ঝামেলায়’ পড়বেন কি-না।

সৌরভের মৃত্যুর পর তাদের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। কলাপসিবল গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকতে না পারলেও বাইরে টিনে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। সৌরভের আরেক ভাই শ্রাবণকেও তারা খুঁজছিল বলে জানান স্বজনরা।

‘ট্রলার নিয়া একাই নদীতে স্বামীর লাশ খুঁজছি’

সজীব খুন হওয়ার পর তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম দুই ছেলেকে নিয়ে চনপাড়ার ভাড়া বাসা ছেড়ে যান। ফলে সেই বাসায় গিয়ে আর কাউকে পাওয়া যায়নি। ২ নম্বর ওয়ার্ডের গলিতে কথা হয় সজীবের ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা দাদি-শাশুড়ির সঙ্গে। তিনি জানান, সজীবের স্ত্রী রাবেয়া দুই ছেলেকে নিয়ে ডেমরার মীরপাড়ায় ভাড়া থাকেন।

তিনি জানান, যেদিন সৌরভের বাড়িতে হামলা হয়, সেদিন সজীবের বাড়িতেও হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।

সজীবের প্রতিবেশী আঁখি বেগম বলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিন বিকালেও সজীবকে তাদের গলিতে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছেন। রাতে শুনতে পান তারে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকদিন পর ‘সেই অনেক দূরে’ শীতলক্ষ্যায় সজীবের বিকৃত মরদেহ পাওয়া যায় বলে জানতে পারেন তারা।

সজীবের স্ত্রী রাবেয়া বেগম মোবাইল ফোনে বলেন, “আমার পরিবারের লোকজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমার স্বামী রাজনীতি করতে না, ভেলপুরি বেচত। তখন তো পুলিশ-প্রশাসন কিচ্ছু ছিল না।

“ওইদিন উনি (সজীব) চনপাড়াতে ছিলেন। তাকে নির্মমভাবে মাইরা নদীতে ফেলছে। ট্রলার দিয়া নদীতে-নদীতে নিজেই স্বামীর লাশ খুঁজছি। কোথাও পাই নাই। কয়েকদিন পর নৌ পুলিশ তার লাশের কথা জানায়। পকেটে আমার বাটন ফোনটা পাইছিল পুলিশ। নইলে তো লাশ চেনার মত কিছু ছিল না।”

সজীব হত্যা মামলায় বহিষ্কৃত যুবদল নেতা শামীম মিয়াসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন রাবেয়া। তিনি বলেন, “আমি বেশি কিছু বলতে পারমু না। কিন্তু আমি এইটার বিচার চাই। আমি কোনো মীমাংসায় যাব না।”

এই মামলায় এক নম্বর আসামি শামীম মিয়া হলেও তাকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

জানতে চাইলে জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (‘গ’ সার্কেল) মেহেদী ইসলাম বলেন, সৌরভ ও সজীব হত্যা মামলার কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার আছেন। বাকিদেরও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনবে পুলিশ।

রূপগঞ্জ থানার একজন পরিদর্শক বলেন, “চনপাড়ায় অভিযান চালানোটা ডিফিকাল্ট। তারপরও শামীমকে ধরতে দুইবার অভিযান চালানো হয়েছিল। সর্বশেষ মার্চে সংঘর্ষে হত্যার ঘটনার পরও র‌্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।”

আলোচনায় ‘যুবদল নেতা’ শামীম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ফলে চনপাড়ায় যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন কিংবা তাদের মাধ্যমে সুবিধাপ্রাপ্ত ছিলেন তারা কেউ আর এলাকায় নেই। স্থানীয়ভাবে এখন সেখানে যে বিএনপির লোকজনের দাপট তা চনপাড়ার অলিতে-গলিতে সাঁটানো ব্যানার-পোস্টার দেখলেই বোঝা যায়।

অগাস্টের পটপরিবর্তনের পর যে চনপাড়ার রাজনৈতিক আধিপত্যেরও রদবদল হয়েছে, সেটা বাজার ও অলিগলিতে লাগানো পোস্টার দেখতেই ঠাহর করা যায়।

অগাস্টের পটপরিবর্তনের পর যে চনপাড়ার রাজনৈতিক আধিপত্যেরও রদবদল হয়েছে, সেটা বাজার ও অলিগলিতে লাগানো পোস্টার দেখতেই ঠাহর করা যায়।

স্থানীয়রা জানালেন, অগাস্টের পর এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব যুবদলের বহিষ্কৃত নেতা শামীম মিয়ার।

শামীম চনপাড়ার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুল খালেকের ছেলে। কয়েকদিন আগেও শামীম ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং রূপগঞ্জ উপজেলা যুবদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক।

মার্চে চনপাড়ায় মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এক সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার পর তাকে যুবদল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের পর রাজনৈতিকভাবে কিছুটা সংকটে পড়লেও শামীম এখনও চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

চনপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক ও পুলিশের অন্তত ১৮ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগস্টের পরের কয়েক মাস সেখানে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির ও মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপুর অনুসারী নেতারা মুখোমুখি ছিলেন। তবে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পর মনিরুজ্জামানের অনুসারী নেতাকর্মীরা কিছুটা বেকায়দায় আছেন।

এখন এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছেন দিপুর অনুসারীরা। আর তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন শামীম মিয়া।

স্থানীয়রা বলছেন, চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চান শামীম মিয়া। তবে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন আব্দুল করিম ও গোলাম রাব্বানী। এর বাইরেও বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন নেতা চনপাড়ার একক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টায় আছেন।

‘চনপাড়া স্বাধীন হইছে ৭ অগাস্টের পর’

শামীম মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে তার চনপাড়ার ব্যক্তিগত কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সেটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। দুদিন পর শামীম মিয়ার মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

চনপাড়া তিন দিক দিয়ে নদীবেষ্টিত। এখানে ঘাটের নিয়ন্ত্রণও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এরকম একটি ঘাটের প্রবেশমুখে বিএনপি নেতা শামীম মিয়ার প্রচার ব্যানার। পাশে রয়েছে একটি শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়। 

চনপাড়া তিন দিক দিয়ে নদীবেষ্টিত। এখানে ঘাটের নিয়ন্ত্রণও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এরকম একটি ঘাটের প্রবেশমুখে বিএনপি নেতা শামীম মিয়ার প্রচার ব্যানার। পাশে রয়েছে একটি শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়। 

শামীম মিয়া বলেন, “আমি থাকি চনপাড়ায়। বাইরে গেলে নিজের এলাকার কথা বলতে পারি না। আগে এই এলাকায় ২৫০-৩০০ মাদকের স্পট ছিল। আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগুলো বন্ধ করেছি। কিন্তু এখনও কিছু হোম ডেলিভারি আছে। এখন যাদের মাদক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

“আমার বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ মিথ্যা। এই ধরনের রাজনীতি করার লোক আমি না। আমি তো ইয়াং মানুষ। আমারে নেতৃত্বে দেখতে অনেক সিনিয়র নেতারও পছন্দ হচ্ছে না। এখন তো বিএনপির অবস্থান ভালো, তাই সবাই এখন আমারে মাইনাস করে নেতা হইতে চায়।”

সজীব হত্যা মামলায় আসামি হওয়া প্রসঙ্গে শামীম বলেন, “সব জায়গায় ৫ অগাস্ট স্বাধীন হইলেও আমাদের চনপাড়া স্বাধীন হইছে ৭ অগাস্টের পর। কারণ, সরকার পতনের পর সমসের বাহিনীর কারণে জয়নাল ও অন্যরা যারা চনপাড়ার বাইরে ছিল তারা ঢুকতে শুরু করে। ওই সময় সমসের আর জয়নাল বাহিনীর মধ্যে ঘটনাগুলো ঘটে। আর এতে আমারে ফাঁসাইয়া দেয়।”

সজীব হত্যা মামলায় বাদীপক্ষ আদালতে মামলা থেকে তার নাম বাদ দিতে ‘লিখিত’ দিয়েছেন বলে দাবি করেন শামীম।

নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর চনপাড়ার পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন এসেছে। সর্বশেষ সংঘর্ষের ঘটনার পর দফায় দফায় যৌথ অভিযান চালানো হয়েছে। ফলে অপরাধমূলক কার্যক্রমও কমে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে।”

মাদক উদ্ধারে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে এ পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য।