
নয়টি (পাঁচটি দেওয়ানি ও চারটি ফৌজদারি) আইনের বিরোধ লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। মামলা দায়েরের আগে এসব আইনের বিরোধ লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে বিরোধের কোনো পক্ষ প্রয়োজনে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে এসব আইনের বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা না করে কেউই সরাসরি মামলা দায়ের করতে পারবে না। আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫-এ এমন বিধান করা হচ্ছে। গত রোববার এই সংশোধনের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে এ বিষয়ে গেজেট জারির সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই এই সংশোধিত অধ্যাদেশের গেজেট জারি হতে পারে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, ২০০০ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ২১ক ধারা অনুসারে সারা দেশে লিগ্যাল এইড অফিসার বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি করেন এবং আইনি সেবাপ্রত্যাশীদের আইনি পরামর্শ প্রদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে সরকারি খরচে সারা দেশে অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আইনি সহায়তা প্রদান কার্যক্রম চালু হয়েছে। আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিটি জেলায় বর্তমানে একজন করে লিগ্যাল এইড অফিসার রয়েছেন। লিগ্যাল এইড অফিসার একজন বিচারক এবং লিগ্যাল এইড অফিসারের কর্মকে এরই মধ্যে গেজেট দ্বারা বিচারিক কর্ম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনের অধীনে থেকে লিগ্যাল এইড অফিসার ‘মধ্যস্থতা কার্যক্রম’ পরিচালনা করেন এবং আইনি প্রক্রিয়ায় দুই পক্ষের সম্মতি ও সমঝোতায় মধ্যস্থতা চুক্তি সম্পাদন করে থাকেন। এ প্রক্রিয়ায় বিরোধ নিষ্পত্তিতে সুফলও মিলছে। অর্থ ও সময় দুটিই সাশ্রয় হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এই সংস্থায় ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫ জন অসচ্ছল বিচারপ্রার্থী বিনামূল্যে আইনি সেবা নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস, দেশের ৬৪ জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল, সরকারি আইনি সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টারে (টোল ফ্রি-‘১৬৪৩০’) মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হয়। আর এ সময়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫২ কোটি ৫১ লাখ ৬১ হাজার ৮১ টাকা আদায় করে বিচারপ্রার্থীদের দিয়েছে জেলা লিগ্যাল অফিসগুলো। শ্রমিকের পাওনা, ভরণপোষণ, খোরপোষসহ নানা খাতে এই টাকা আদায় করে বিচারপ্রার্থীদের দেন লিগ্যাল এইড কর্মকর্তারা। বর্তমানে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, তা তিন গুণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার আইন সংশোধন করে এই অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সারা দেশে ৪৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। মামলাজট চরম আকার ধারণ করেছে। বিদ্যমান মামলার সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন দায়েরকৃত মামলা যুক্ত হচ্ছে। মামলার সংখ্যানুপাতে বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। এ অবস্থায় যেসব বিরোধ এবং অভিযোগ আপসযোগ্য অথবা বিবদমান পক্ষগণের সমঝোতায় দ্রুত এবং সহজে নিষ্পত্তি করা সম্ভব, সেসব বিরোধ বা অভিযোগ চিহ্নিতক্রমে মামলা দায়েরের আগেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা গেলে বিচারপ্রার্থীগণ যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি এ খাতে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ও হ্রাস পাবে। এজন্য দেওয়ানি পাঁচটি ও ফৌজদারি চারটি আইনে উল্লেখিত বিরোধ ও অভিযোগ এমন প্রকৃতির, যেগুলো মধ্যস্থতার মাধ্যমে দ্রুত এবং টেকসইভাবে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।
সংশোধিত অধ্যাদেশে যেসব আইনের বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ধারা ৫-তে উল্লেখিত বিষয়; বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১-তে উল্লেখিত বিরোধ; সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত কটন সম্পর্কিত বিরোধ; স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট-১৯৫০-এর সেকশন ৯৬-তে উল্লেখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ; নন-এগ্রিকালচার টেনান্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯-এর সেকশন ২৪-এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ: পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩-এর ধারা ৮ অনুসারে পিতা-মাতার ভরণপোষণ সম্পর্কিত বিরোধ; নিগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর সেকশন ১৩৮-এ বর্ণিত চেক ডিজঅনার সম্পর্কিত অভিযোগ (অনধিক ৫ লাখ টাকা মূল্যমান চেকের ক্ষেত্রে); যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ধারা ৩ ও ৪ তে বর্ণিত যৌতুক সম্পর্কিত অভিযোগ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ১১(গ)-তে বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগ।
সংশোধিত অধ্যাদেশে ৯টি আইনের বিরোধের বিষয়ে মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘উপধারা-(১) আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা বিষয়ে এই আইনের বিধানাবলি কার্যকর হবে। উপধারা-(২) এই আইনের তপশিলে বর্ণিত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ পক্ষকে আবশ্যিকভাবে ওই বিরোধ প্রথমে লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে আবেদন করতে হবে; মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে বিরোধের কোনো পক্ষ প্রয়োজনে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। উপধারা (২) অনুসারে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে মামলা দায়েরকারীকে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে দাখিল করতে হবে। উপধারা (২) অনুসারে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত সময় তামাদির মেয়াদ গণনার ক্ষেত্রে বাদ যাবে।’
এদিকে সংশোধিত অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এতে প্রতিটি লিগ্যাল এইড অফিসে লিগ্যাল এইড অফিসারের পাশাপাশি একজন চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার ও স্পেশাল মেডিয়েটর নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের মধ্য হতে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার এবং লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ ও পদায়ন করবে এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সংস্থা, সময় সময়, আদেশ দ্বারা নির্ধারণ করবে। চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত সংস্থা আদেশ দ্বারা লিগ্যাল এইড অফিসারকে, ক্ষেত্রমত, চিফ লিগ্যাল এইড অফিসারের দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার বা লিগ্যাল এইড অফিসার আইনগত সহায়তা প্রার্থীকে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, আইনি পরামর্শ প্রদান করতে পারবে, মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে এবং প্রচলিত আইনের অধীন আপসযোগ্য যে কোনো বিষয় কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনাল মামলা দায়ের-পরবর্তী মধ্যস্থতা কার্যক্রমের জন্য পাঠালে তা নিষ্পত্তির ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট অফিসারের থাকবে।’
মধ্যস্থতা-চুক্তির কার্যকারিতা বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, ‘(১) পক্ষগণের স্বাক্ষর ও মধ্যস্থতাকারীর স্বাক্ষরক্রমে সম্পাদিত এবং চিফ লিগ্যাল এইড অফিসার কর্তৃক প্রত্যায়িত প্রতিটি মধ্যস্থতা চুক্তি চূড়ান্ত, বলবৎযোগ্য এবং পক্ষগণের ওপর বাধ্যকর হবে। (২) উপধারা (১)-এর অধীন চুক্তি আদালতের ডিক্রি অথবা ক্ষেত্রমত, চূড়ান্ত আদেশ বলে গণ্য হবে এবং এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতের মাধ্যমে উক্ত ডিক্রি বা আদেশ জারি করা যাবে। এই আইনের অধীন মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা কার্যক্রম চলমান অবস্থায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ উদ্ভূত হলে লিগ্যাল এইড অফিস প্রয়োজনীয় আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবে এবং উক্ত আদেশ বা নির্দেশ বাস্তবায়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে।’
স্পেশাল মেডিয়েটর নিয়োগের ব্যাপারে সংশোধিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘(১) এই আইনের অধীনে স্পেশাল মেডিয়েটর হিসাবে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সংস্থা, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এবং মধ্যস্থতা বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইনজীবীগণের মধ্য হতে স্পেশাল মেডিয়েটরগণের একটি তালিকা প্রস্তুত করবে। সংস্থা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, উক্ত তালিকা হতে প্রত্যেক লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতা কার্যক্রমের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্পেশাল মেডিয়েটর নিয়োগ প্রদান করবে।’
সংস্থার বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ৬(ছয়), যেখানে সিনিয়র জেলা জজ/জেলা জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক পরিচালক, যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার দুজন বিচারক উপপরিচালক রয়েছেন। সারা দেশে লিগ্যাল এইড-এর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সংস্থার মাত্র ৬ জন কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে ‘পরিচালক’-এর একটিমাত্র পদ নির্ধারিত থাকায় সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পদ ও শাখা সৃজন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে সংশোধিত অধ্যাদেশে সংস্থায় ‘পরিচালক’ পদটি ‘নির্বাহী পরিচালক’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। এতে করে সংস্থার প্রয়োজনানুসারে জনবল সৃজন সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশোধিত অধ্যাদেশের বিষয়বস্তু তুলে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ড. মো. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘বর্তমানে সারা দেশের আদালতগুলোতে মামলা জট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর এমনকি যুগ পার হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিকল্প উপায়ে আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প নেই। সেজন্য সরকার আইনগত সহায়তা আইন সংশোধন করে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা প্রশংসনীয়। এটি কার্যকর হলে আদালতে যাওয়ার আগেই একজন বিচারকের মধ্যস্থতায় বিরোধ নিষ্পত্তি হবে। এতে করে সময় ও অর্থ ব্যয় কমে আসবে। বিচারপ্রার্থীরা উপকৃত হবেন।’