Image description

সরকারের স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তাবিত দুটি মেগাপ্রকল্প, যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। প্রকল্প দুটি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই, অস্বচ্ছ বরাদ্দ এবং প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রকল্প দুটিতে। ফলে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ফেরত পাঠিয়ে সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে।

সম্প্রতি পৃথক দুটি পিইসি সভায় প্রকল্প দুটি ফেরত দিয়ে বিস্তারিত ব্যয়ের তালিকা ও সম্ভাব্যতা যাচাইসহ সংশোধিত ডিপিপি জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ব্যয় কাঠামোতে অসংখ্য অস্পষ্টতা থাকায় অনুমোদনের আগেই প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রস্তাবিত প্রকল্প দুটি হলো ১৫ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবার উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প ও জলবায়ু সহনশীল প্রজনন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সেবা উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প। যার ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা।

এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার ৮১১ কোটি টাকা (যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৩৯.৪৩ শতাংশ) আসবে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে, বাকি অর্থ জোগান দেবে সরকার।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এই প্রকল্পগুলোর জন্য জুন মাসের মধ্যেই উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত না হলে ৪০৪ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা ঝুঁকিতে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে চিঠি দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে পাঁচটি স্বাস্থ্য প্রকল্প অনুমোদনের অনুরোধ করেন। যার মধ্যে এই দুটি প্রকল্পও রয়েছে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা সেই চিঠির কপি পরিকল্পনা সচিব ও সংশ্লিষ্ট সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাতেও জটিলতা কাটেনি।

পরিকল্পনা কমিশনের সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রউফ জানিয়েছেন, দুটি প্রকল্পই চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে অনুমোদনহীন নতুন প্রকল্পের তালিকায় নেই।

আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রকল্পের কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি, নিয়োগ ও যানবাহন ক্রয়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেই, ইআরডির মাধ্যমে দাতা সংস্থার চুক্তিপত্র বা কমিটমেন্ট লেটারও জমা পড়েনি

প্রকল্প প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় থাকা প্রথম প্রকল্পে ৫৪টি উপাদানের মধ্যে ৪৫টি অস্বচ্ছ বরাদ্দ ধরা হয়েছে। মোট ১৫ হাজার ১২৪ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ১১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার ধরন, পরিমাণ বা গুণগত মান স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে ছয় হাজার ২১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ওষুধ, টিকা ও চিকিৎসাসামগ্রীর জন্য।

কিন্তু সেখানে পণ্যের নির্দিষ্ট তালিকা নেই। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী খরচের বিস্তারিত তালিকা প্রস্তুত করতে হবে, আর বাজারদরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্য বলেন, এই প্রকল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যয় শুধু ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও টিকা খাতে বরাদ্দ। অথচ এ ধরনের পুনরাবৃত্ত ব্যয় ধাপে ধাপে সরকারের পরিচালন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। এই পরিবর্তন প্রকল্পের এগজিট প্ল্যানে পরিষ্কারভাবে থাকতে হবে।

এ ছাড়া দুটি প্রকল্পে তিন হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা ভবন নির্মাণের জন্য ধরা হলেও মূল প্রকল্প কার্যক্রমে তার উল্লেখ নেই। কমিশন বলছে, এ ধরনের নির্মাণ ব্যয় আলাদা একটি অবকাঠামো প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত এবং একই ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে সম্ভাব্য ডুপ্লিকেশন এড়াতে পর্যালোচনা করতে হবে।

এ ছাড়া দুটি প্রকল্পে ২৬১ কোটি টাকার পরামর্শক সেবা ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। পরামর্শকদের সংখ্যা, পারিশ্রমিক এবং কাজের পরিধি অনুযায়ী ব্যয়ের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পরামর্শকদের জন্য পৃথক টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) ও বিস্তারিত অর্থ ব্যয়ের কাঠামো জমা দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিনের সেক্টরভিত্তিক কর্মসূচি বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন আলাদা প্রকল্পভিত্তিক উদ্যোগে যাচ্ছে। এতে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সমন্বয় ও স্থায়িত্ব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে।