
অনেক টালবাহানার পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ইরান ও ইসরায়েল। টানা ১২ দিনের যুদ্ধ আপাতত থেমেছে। তার পরই যুদ্ধজয়ের কৃতিত্ব দাবি করেছে কেবল ইরান, ইসরায়েলই নয়, আমেরিকাও। তিন পক্ষের দাবির সমর্থনেই বেশ কিছু যুক্তি আছে। উল্টো দিকে আছে কিছু প্রতিযুক্তিও। স্বাভাবিকভাবে যা তারা স্বীকার করেননি বা করতে চাইবেন না। ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ভেস্তে দিতে কেবল বন্ধু ইসরায়েলকে সমর্থনই নয়, সরাসরি ময়দানেও নামে আমেরিকা।
গত রবিবার ইরানের তিন পরমাণু কেন্দ্রে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে আমেরিকার ‘বি২ বম্বার’ বোমারু বিমান। কিন্তু আমেরিকার এই অতর্কিত হামলায় কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলো? এ সংক্রান্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রাথমিক মূল্যায়নের প্রতিবেদন প্রকাশ্যে এসেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ওই প্রতিবেদনকে উল্লেখ করে জানায়, মার্কিন হামলায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়নি ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলো। তাদের পরমাণু কর্মসূচি শুধু কয়েক মাস পিছিয়ে গিয়েছে মাত্র! মার্কিন গোয়েন্দাদের এ তথ্যের সঙ্গে একমত নন স্বয়ং ট্রাম্প। সাফল্যের ঢাক পিটিয়ে তাঁর দাবি, ইরানের পারমাণবিক পরিকাঠামো ধ্বংসের পাশাপাশি যুদ্ধও বন্ধ করেছেন তিনি।
ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, তেহরানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির চেষ্টা এবং সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি রোধ করতে পারলেন না ট্রাম্প। তবে যুদ্ধে লাগাম পরানোর কৃতিত্ব তিনি দাবি করতেই পারেন। তাতে তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। এদিকে, মঙ্গলবার ট্রাম্প প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পর ইসরায়েলের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল ‘ইসরায়েল দুটি অস্তিত্বগত ঝুঁকি নষ্ট করে দিয়েছে। একটি ছিল পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত ঝুঁকি, অপরটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত ঝুঁকি।’
১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল একাধিকবার সামরিক আধিপত্যের প্রমাণ রেখেছে। এ সময়ে ইরানের নয়, পরমাণুবিজ্ঞানী এবং তেহরানের প্রথম সারির সেনা কর্মকর্তারা তেল আবিবে চোরাগোপ্তা হানায় নিহত হয়েছেন। এর আগে ইরাক এবং সিরিয়ার পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালালেও এই প্রথম ‘চিরশত্রু’ ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল। তা ছাড়া ইরান বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য কতটা ঝুঁকির। আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশ এ বিষয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সহমত পোষণ করে। গাজা ভূখণ্ডেও হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ইসরায়েল। সেখানে ইসরায়েলি সেনার বিরুদ্ধে বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইসরায়েলকে দুটি বার্তা দেওয়ার মঞ্চ গড়ে দিল বলে মনে করছেন অনেকে।
একটি হলো, ইসরায়েল যে একই সময়ে একাধিক যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করতে পারে, সেই বার্তা দেওয়া। দুই, ইরানের কার্যকলাপে নিরাপত্তাগত ঝুঁকির কথা তুলে গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে কিছুটা লঘু করা বা বিষয়টা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত ছিল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছেও বড় পরীক্ষা। তাঁর দাবি, তিনি এই পরীক্ষায় সফল। তবে তিনি সফল কি না, আগামী বছরের নির্বাচনে তার রায় দেবেন ইসরায়েলের জনগণ। দুর্নীতি, অপশাসনের অভিযোগ এড়িয়ে নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি নির্বাচনে ফের জয়ী হতে পারে কি না, সে দিকে নজর সবারই।
এদিকে, ইসরায়েল এবং আমেরিকার যৌথ প্রচেষ্টার পরও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি ভেস্তে যায়নি। এমনই দাবি আমেরিকার গোয়েন্দাদের। ৪০০ কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকে তারা কোনো গোপন কুঠুরিতে রেখেছে, তার হদিস পায়নি আমেরিকা কিংবা ইসরায়েল। তেহরানেরও দাবি, তারা পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। ইরান কেবল ইসরায়েলকেই পাল্টা আক্রমণ করেনি, ওয়াশিংটনকে জবাব দিতে কাতারের মার্কিন সেনাঘাঁটিতেও হামলা চালিয়েছে। তা ছাড়া বহিঃশত্রু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের গোঁড়া ধর্মীয় প্রশাসনের পাশে যেভাবে সে দেশের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা অভাবনীয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক অতীতে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের রক্ষণশীল আচরণের প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন ইরানের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও। কিন্তু ‘ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার স্বার্থে’ যুদ্ধ খামেনি প্রশাসনের পাশে এনে দাঁড় করিয়েছে সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে। অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার রাজনৈতিক এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ল। তা ছাড়া প্রথমে ইসরায়েলের সুরে জমানা বদলের কথা বললেও ট্রাম্প মঙ্গলবার জানিয়েছেন, ইরানে শাসকবদল তিনি চান না। এ ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি, শাসকবদলের সময়ে বিশৃঙ্খলা হয়। তবে আপাতত সাফল্যের মাঝে অনেক কাঁটাও আছে ইরানের। ইরান ১২ দিনের যুদ্ধে সেনাপ্রধানসহ একাধিক সামরিক কর্তাকে হারিয়েছে। হারিয়েছে দেশের প্রায় ৬৫০ নাগরিককেও। তা ছাড়া ইরানের শাসনব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে যে ইসরায়েলি গুপ্তচর বাহিনী মোসাদের নজরদারি রয়েছে। এ সংঘাতে তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমেরিকার হুঁশিয়ারি এড়িয়ে খামেনি প্রশাসন কীভাবে নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যায়, তা-ই এখন দেখার বিষয়।