
ঈদের আগে সাগর কোম্পানির ৫০ কেজির বস্তা মিনিকেট চালের মিলগেটে দাম ছিল ৩ হাজার ৩৩০ টাকা। ঈদের পর তা বিক্রি করা হচ্ছে ৩ হাজার ৭৫০ টাকায়। এর সঙ্গে যোগ হবে পরিবহন ব্যয় ও কুলির মজুরি।
সব মিলিয়ে পাইকারি বাজারে বস্তায় বেড়েছে ৪২০ থেকে ৫০০ টাকা, আর কেজিতে বেড়েছে ৮ থেকে সাড়ে ৮টাকা। খুচরা বাজারে কেজিতে বেশি রাখা হচ্ছে ১০ টাকার মতো। এভাবে একই হারে বেড়েছে অন্যান্য কোম্পানির মিনিকেট চালের দাম। এই লাগামহীন মূল্য কার্যকর করার জন্য কমিয়ে দেওয়া হয়েছে সরবরাহ।
গতকাল মঙ্গলবার এসব তথ্য জানান রাজধানীর কারওয়ান বাজারের চাঁদপুর রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী বাচ্চু মিয়া। এর আগে সোমবার রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি চালের আড়ত বাবুবাজারে গিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে মিনিকেট চালের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ থেকে ৪ হাজার টাকা, যা ঈদের আগেও বিক্রি হয়েছিল ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকা। একইভাবে ২ হাজার ৫৫০ টাকার বিআর-২৯ চাল ২ হাজার ৯০০, আর ২ হাজার ৭০০ টাকার ২৮ চাল ৩ হাজার ২০০ এবং ২ হাজার ৭০০ টাকার সুমন স্বর্ণা ২ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সদ্য বাজারে ওঠা শম্পা কাটারি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। আর একই জাতের পুরাতন চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ৫০০ টাকা কমে পাওয়া যেত। এটি পাইকারি বাজারের হিসাব। পাইকারিতে বাড়ায় খুচরা পর্যায়েও মানভেদে কেজিতে তিন থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২৮ ও মিনিকেটের দাম।
খুচরায় মিনিকেটের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৫ টাকা, যা কদিন আগেও ছিল সর্বোচ্চ ৮২ থেকে ৮৫ টাকা। ২৯ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৩ থেকে ৭৪ টাকায়, যা ছিল ৬৩ থেকে ৬৪ টাকা, ২৮ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়, যা ছিল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা, সুমন স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৪ টাকা, যা ছিল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। পুরাতন শম্পা কাটারি বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ৯৬ টাকায় আর নতুন ৮৫ থেকে ৮৬ টাকায়।
দেশে ধান-চালের অন্যতম মোকাম বা উৎপাদনস্থল নওগাঁ ও দিনাজপুর জেলার বাজারে হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর বাজারেও চালের দাম বেড়েছে। চলতি বছর বোরো ধানের মৌসুমে অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। কদিনের ব্যবধানে মানভেদে বস্তাপ্রতি ৫০০ টাকা পর্যন্ত আর কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভোক্তারা।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ক্রেতারা বলছেন, নতুন ধান উঠতে না উঠতেই বেড়েছে প্রায় সব ধরনের চালের দাম। ভরা মৌসুমে কীভাবে দাম বাড়ে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
কেরানীগঞ্জ মডেল টাউনের মাহবুব হোসেন বলেন, এগুলো ব্যবসায়ী আর মিলারদের কারসাজি। আসলে বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।
তেজতুরি বাজার এলাকার সেলিনা খাতুন বলেন, ভরা মৌসুমেও যদি চালের দাম বাড়ে, তাহলে কমবে কখন? কদিনের ব্যবধানে ৭৫ টাকার চাল ৮০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
বাবুবাজারের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, হঠাৎ করে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা কারণ জানতে চাচ্ছে; কিন্তু আমরা কিছুই বলতে পারছি না। মিল মালিকরা বলছেন, ধানের দাম বেশি, তাই চালের দাম বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান বলেন, সরকারের মজুত নীতিমালার তোয়াক্কা করছেন না অসাধু মজুতদাররা। বোরো মৌসুমের শুরুতেই করপোরেট ব্যবসায়ীরা হাট-বাজারে আসা অর্ধেকের বেশি ধান কিনে মজুত করেন। কৃষকের ধান সাধারণ মিলারদের হাতে একেবারে নেই বললেই চলে। এখন তারা ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে চালের দাম বাড়াচ্ছে।
নওগাঁর চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, চালের দাম দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। কিন্তু ছয়-সাত টাকা দাম বাড়িয়েছে ব্র্যান্ডিং কোম্পানি। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে কৃষকদের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কেনায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রামে হঠাৎ অস্থির চালের বাজার
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, চট্টগ্রামে হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠেছে চালের বাজার। গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫ থেকে ৮ টাকা। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছয়টি করপোরেট গ্রুপ ও উত্তরাঞ্চলের কিছু মিল মালিক সিন্ডিকেট করে এই সংকট তৈরি করেছে।
নগরীর বহদ্দারহাট, চাকতাই, পাহাড়তলী ও চকবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত। সাধারণ মিনিকেট চাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৮ থেকে ৭০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৬২ থেকে ৬৩ টাকা। মাঝারি মানের স্বর্ণা ও ব্রিআর-২৮ চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। কাটারিভোগের দাম কেজিপ্রতি ৮৫ থেকে ৮৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। পাইজাম চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৬ টাকায়। মোটা চাল হিসেবে পরিচিত স্বর্ণার দামও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭-৫৮ টাকায়, যা আগে ছিল ৫৪-৫৫ টাকার মধ্যে।
বহদ্দারহাটের মক্কা ট্রেডার্সে চাল কিনতে আসা শ্রমজীবী কুলসুম বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগে ৫ কেজি চাল কিনতাম, এখন ৩ কেজিও নিতে কষ্ট হয়। ফলে সংসার চালানোই দায় হয়ে গেছে।
ক্যাবের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোছাইন বলেন, সরকার যদি সারা বছর বাজার নজরদারিতে রাখে এবং ধান সংগ্রহ ও মজুতে নীতিমালা প্রণয়ন করে, তাহলে এ সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
রাজশাহীতেও চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী
রাজশাহী অফিস জানায়, রাজশাহীতে এ বছর ধানের ভালো ফলন হয়েছে। এরপরও নতুন-পুরোনো সব ধরনের চালের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার জন্য মিল মালিকদের দায়ী করছেন। তারা বলছেন, বাজারে চাল সরবরাহে কোনো সংকট নেই। মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় দাম বাড়ছে।
গত সোমবার রাজশাহীর বিভিন্ন চালের আড়ত ও দোকান ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা জানা যায়, ঈদের আগে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৭৫ টাকা। সেই চাল এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়। ২৮ জাতের প্রতি কেজি চালের দাম ঈদের আগে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬২ টাকায়। এখন সেই চাল ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। ঈদের আগে জিরাশাইল ছিল ৬৪-৬৬ টাকা; বর্তমানে ৭০-৭২ টাকা; কাটারি ছিল ৬৬-৬৮ টাকা, বর্তমানে ৭৫-৮০ টাকা; ব্রিআর-২৮ জাতের চাল ছিল ৫৯-৬০ টাকা, বর্তমানে ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ চাল বিক্রি হয়েছে ৫৩-৫৪ টাকা, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়।
রাজশাহী চালকল মালিক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এর আগেও এমন সময় দাম বেড়েছিল। আর বড় বড় কোম্পানি এসব কারসাজি করছে।
দাম বাড়ার জন্য সরকারের চালের বাজার তদারকির অভাবকেই দায়ী করছেন বাজার-বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, বাজারে তদারকি না থাকায় চালের দাম বাড়ছে এবং চাল সিন্ডিকেট ভয়ংকর হয়ে উঠছে।