
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত নৌপথে যান চলাচল দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ভারতীয় নৌযানের বেপরোয়া চলাচলের কারণে বিপর্যস্ত সুন্দরবন। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণা রিপোর্টে উঠে এসেছে আশঙ্কার নানা দিক। এ পথে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে আশু ব্যবস্থা নিতে সুন্দরবন বিভাগ একাধিকবার বন বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হলে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
নৌযান চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএর আইন রয়েছে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত নৌযান না চালানোর। দেশি নৌযানগুলো এই নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু ভারত থেকে আসা জাহাজ বা কার্গোগুলো এসবের ধার ধারে না। তারা দিন-রাতের বিষয় বিবেচনা না করে বরং জোয়ার-ভাটা বিবেচনা করে জাহাজ চালায়। এতে তাদের সময় বাঁচে, জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হয়।
তারা জানায়, বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেশিরভাগ জাহাজ খালি যায়। ভারত থেকে সিমেন্টের কাঁচামাল ফ্লাই অ্যাশ, কয়লা, ফার্নেস অয়েল, পাথর, স্টিল সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে ফেরে।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নৌযান চলাচলের ক্ষতির দিক নিয়ে গবেষণা করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ। বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, দিন-রাত বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের ক্ষতির নানামুখী দিক আছে। দিনের চেয়ে রাতে চলাচলে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। কারণ সে সময় প্রাণীদের বিশ্রামের সময়। যে রুট ধরে জাহাজ চলছে, আগে এই বনাঞ্চলে বাঘ, হরিণ, শূকরসহ অন্যান্য প্রাণী সহসা দেখা যেত। জাহাজের উচ্চ শব্দ, পানিতে কম্পন, রাতে লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করায় তারা মাইগ্রেট করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি জানান, লাইটারেজ জাহাজগুলো ২০-৩০ নটিক্যাল মাইল বেগে চলে। এতে যে ঢেউ সৃষ্টি হচ্ছে তাতে নদীর পাড় ভাঙছে, বনের আকার ছোট হচ্ছে। আগে যে নদী ২০ থেকে ৩০ মিটার প্রস্থ ছিল, এখন তা ৫০ থেকে ৬০ মিটারে পৌঁছেছে।
ড. আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, চলার পথে এরা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নোঙ্গর করে। এ সময় নানা ধরনের বর্জ্য, আবর্জনা, পোড়া জ্বালানি তেল, রাসায়নিক দ্রব্য-সার ইত্যাদি পানিতে পড়ছে। প্রতি বছরই সুন্দরবনের ভেতর অথবা সংলগ্ন নদীতে জাহাজডুবি ঘটছে। জোয়ার-ভাটার প্রভাবে এসব অপদ্রব্য গোটা সুন্দরবনের মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে গাছের ভ্রুণ থেকে চারা গজাচ্ছে না। এতে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে। গাছের পাতা, ফুল ও ফলে বিষ ছড়াচ্ছে। ফলে প্রাণীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের প্রজনন ক্ষমতা কমছে। মাছের উৎপাদন কমছে। প্রতি বছরই মধুর উৎপাদনও কমছে সুন্দরবনে।
তিনি আরো জানান, বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের শেষ আশ্রয়স্থল সুন্দরবন। কিন্তু এই নৌরুট ইরাবতী ডলফিনের অভয়াশ্রমের ভেতর দিয়ে গেছে। ফলে বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীটিও হুমকির মুখে। একই অবস্থা কুমিরের ক্ষেত্রেও। চৈত্র-বৈশাখ মাসে কুমির ডিম পাড়ে। ডিম পাড়া ও বাচ্চা ফুটানোর জন্য তাদের দরকার নিরিবিলি স্থান। অব্যাহতভাবে জাহাজ চলাচলের কারণে কুমিরের প্রজনন কমে গেছে। কুমির সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ের দিকে চলে আসছে।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধে স্বাধীনতার পরপরই মোংলায় ঘষিয়াখালী চ্যানেল খনন করা হয়েছিল। এখানে আন্তর্জাতিক নৌরুট রয়েছে, যা দিয়ে অফসোর হয়ে সব নৌযান চলাচল করতে পারে। আকরাম পয়েন্ট ও হিরণ পয়েন্ট ব্যবহার করে আসা-যাওয়া করতে পারে। এজন্য সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাস্তবায়নের জন্য নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড রয়েছে, যারা এন্ট্রি পয়েন্টে তাদেরকে আটকে দিতে পারবে বলে জানান তিনি।
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমান আমার দেশকে জানান, বনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচলের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আমরা একাধিকবার লিখিতভাবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এভাবে নৌযান চলাচল জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ প্রতিবেশের জন্য হুমকি। এসব নৌযান পশুর চ্যানেল হয়ে অফশোর দিয়ে চলাচলের সুযোগ আছে বলেও জানান তিনি।
খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার আংটিহারা শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে এই রুটে জাহাজ চলেছিল ৪ হাজার ৩২৮টি। প্রতি মাসে গড়ে চলেছে ৩৬১টি। ২০২৩ সালে এই পথে দুই দেশের মধ্যে ৮ হাজার ৩৪২টি জাহাজ চলাচল করেছে। মাসে গড়ে চলেছে ৬৯৫টি। গত ১০ বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের জন্য ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান দেয় ইউনেসকো।