নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল উপ-শহরের ৪ নম্বর সেক্টরে বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে বসেছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ২৯তম আসর। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ১ জানুয়ারি মেলার উদ্বোধন করেছেন। এ নিয়ে পূর্বাচলের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে এই মেলা হতে যাচ্ছে চতুর্থবার। তবে এবারের মেলায় আসা ব্যবসায়ী ও কর্মচারী বাসা ভাড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী ও স্টলের কর্মচারী মেলার আশপাশে থাকার জন্য বাসা না পেয়ে ঢাকা এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আসা-যাওয়া করতে ভোগান্তিতে পড়ছেন প্রতিদিন।রবিবার সরেজমিনে মেলা ঘুরে ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বাসা ভাড়া নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন। দ্বিগুণ দাম দিয়েও চাহিদামতো বাসা ভাড়া পাচ্ছেন না। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কয়েকজন ব্যবসায়ী ও কর্মচারী। বাসা ভাড়া নিয়ে মেলা কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন তারা।
ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা বলছেন, গত চার বছর ধরে পূর্বাচলের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে বাণিজ্য মেলা বসছে। প্রতি বছর যেহেতু এখানে মেলা বসছে সেহেতু তাদের স্টল বরাদ্দ নিতে হচ্ছে। শত শত ব্যবসায়ী মেলায় স্টল বরাদ্দ নিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে রয়েছেন শত শত কর্মচারী। অথচ তাদের থাকার জন্য আশপাশে কোনও ব্যবস্থা নেই। দূরদূরান্ত থেকে এসে প্রতিদিন তাদের ব্যবসা সামলাতে হচ্ছে। যারা স্টল বরাদ্দ নিচ্ছেন তাদের জন্য মেলার আশপাশে মেলা কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল থাকার একটা ব্যবস্থা করার। তাহলে ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। আশপাশের ভাড়া বাসায় থেকে ব্যবসা করাটা সহজ হতো।
মেলায় স্টল বরাদ্দ নেওয়া দুজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, মেলায় এবার তিন শতাধিক স্টল ও প্যাভিলিয়ন রয়েছে। ব্যবসায়ী ও কর্মচারী মিলে দুই হাজারের বেশি লোক কাজ করেন। এখান থেকে রাতে নিজেদের বাসায় যাওয়া সম্ভব হয় না অনেকের। ফলে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য কর্মচারীও পাওয়া যায় না। যানজট, ভাঙা সড়ক এসবের কারণে বাসায় যেতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। স্টল ও প্যাভিলিয়ন যেহেতু স্থায়ী তাই তাদের থাকার জন্য স্থায়ী একটা ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেলায় প্রতিদিন যাতায়াতে ভোগান্তির কথা জানিয়ে তুর্কি প্যাভিলিয়নের সেলসম্যান লিংকন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাসা গাজীপুরে। ওখান থেকে প্রতিদিন এসে গিয়ে কাজ করাটা মুশকিল। আবার এখানের আশপাশে থাকার মতো বাসা ভাড়া পাচ্ছি না। পাঁচ দিন চলে গেলো। এখনও বাসা ভাড়া পাইনি। ফলে প্রতিদিন গাজীপুর থেকে এসে কাজ করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। মেলা কর্তৃপক্ষের উচিত এখানে থাকার একটা ব্যবস্থা করার। এখনও সময় আছে, যদি একটা ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে সবার জন্য ভালো হবে।’
তুর্কি প্যাভিলিয়নের মালিক আজমল হোসেন জানিয়েছেন, মেলায় ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের আসা-যাওয়া করে কাজ করতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এখানের সময়টা মূল্যবান। সময়মতো কাজে না আসা গেলে ব্যবসা শুরু করা যায় না। যানজট ও ভাঙা সড়কের কারণে ঠিক সময়ে স্টলে পৌঁছানো যায় না।। এত বড় মেলা। অথচ এখানের আশপাশে বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না। মেলা কর্তৃপক্ষ একটা উদ্যোগ নিলে ভালো হয়।সাবিহা কর্নারের মালিক জিয়াউল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১ জানুয়ারি থেকে স্টল নিয়ে ব্যবসা করছি। স্টলে ছয় জন লোক কাজ করছি। মেলা এলাকার বাইরে যেসব বাসা ভাড়া পাওয়া যায় সেগুলোতে দিগুণ ভাড়া চায়। তাও চাহিদামতো নয়। তবু দিগুণ ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। স্টলে রাতে থাকা কী সম্ভব ছয় জন লোকের। বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া উচিত মেলা কর্তৃপক্ষের। না হয় আগ্রহ হারাবেন ব্যবসায়ীরা।’
প্রতি বছর থাকা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে জানালেন বি এম কালেকশনের মালিক অলিউর রহমান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলা আসার পর থেকে স্টল বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করছি। প্রতি বছর বাসা ভাড়া নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। মেলার পাশে বাসা ভাড়া নিতে গেলে ঢাকার চেয়ে দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। তাও চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যায় না। কী আর করার বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে আমাদের।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাণিজ্য মেলার পরিচালক বিবেক সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেলার আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে যাতে ব্যবসায়ীদের বিপাকে পড়তে না হয়, সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে।’এবার শুরুতেই মেলা অনেকটা জমে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বারের চেয়ে এবারের মেলায় ভালো ব্যবসা হবে বলে আশা করছি। এবার সবকিছু সাজানো-গোছানো হয়েছে। বাকি যেসব ছোটখাটো সমস্যা আছে, সেগুলোরও সমাধান হয়ে যাবে।’
দেশীয় পণ্যের প্রচার, প্রসার ও বিপণনের পাশাপাশি এসব পণ্যের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার (ডিআইটিএফ) আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশ। পূর্বাচলের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে এবারসহ চতুর্থবারের মতো বাণিজ্য মেলা হচ্ছে। মেলার যৌথ আয়োজক বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিদেশি সাত দেশের ১১ প্রতিষ্ঠান এবারের মেলায় অংশ নিয়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হলো ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, হংকং ও মালয়েশিয়া।
মেলায় এবার ৩৬২টি স্টল ও প্যাভিলিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫১টিই দেশীয় প্রতিষ্ঠানের স্টল-প্যাভিলিয়ন। বাকি ১১টি স্টল ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, হংকং ও মালয়েশিয়ার।
প্রথমবার অনলাইনে স্টল-প্যাভিলিয়ন ও ই-টিকিটিং
আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এবারের বাণিজ্য মেলায় এই প্রথম অনলাইনে বিভিন্ন ক্যাটাগরির স্টল/প্যাভিলিয়ন স্পেস বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই প্রথম ই-টিকিটিংয়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বিআরটিসির নির্ধারিত বাসসেবা থাকবে। পাশাপাশি থাকছে বিশেষ ছাড়ে উবার সেবা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের সম্মানার্থে মেলায় তৈরি করা হয়েছে জুলাই চত্বর ও ছত্রিশ চত্বর। তরুণসমাজকে রফতানি বাণিজ্যে উদ্বুদ্ধ করতে ইয়ুথ প্যাভিলিয়ন করা হয়েছে।
থাকছে যেসব কর্নার
মেলায় এ বছরই প্রথম সম্ভাবনাময় খাত/পণ্যভিত্তিক সেমিনার আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশি উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানের সুবিধার্থে থাকছে স্বতন্ত্র সোর্সিং কর্নার, ইলেকট্রনিকস ও ফার্নিচার জোন। বয়সভিত্তিক দর্শনার্থীদের সুবিধায় তৈরি করা হয়েছে প্রযুক্তি কর্নার, জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য সিটিং কর্নার। শিশুদের নির্মল চিত্তবিনোদনের জন্য মেলায় থাকছে শিশুপার্ক। মা ও শিশুদের জন্য মেলায় থাকবে মা ও শিশুকেন্দ্র। দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য আরামদায়ক এবং শোভন চেয়ার ও বেঞ্চ রয়েছে।
৩৬২ প্যাভিলিয়ন ও স্টল
বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৩৬২টি প্যাভিলিয়ন, স্টল ও রেস্তোরাঁ আছে এবারের মেলায়। দেশীয় উৎপাদক-রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানসহ সাধারণ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে শত ভাগ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এসব বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দেশীয় বস্ত্র, যন্ত্রপাতি, কার্পেট, প্রসাধনসামগ্রী, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস পণ্য, আসবাব, পাট ও পাটজাত পণ্য, গৃহস্থালি সামগ্রী, চামড়া, আর্টিফিশিয়াল চামড়া, জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য, খেলার সামগ্রী, স্যানিটারিওয়্যার, খেলনা, স্টেশনারি, ক্রোকারিজ, প্লাস্টিক, মেলামিন, পলিমার, হারবাল, টয়লেট্রিজ, ইমিটেশন জুয়েলারি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, ফাস্ট ফুড, হস্তশিল্পজাত পণ্য, গৃহসজ্জার উপকরণ ইত্যাদি মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রি হচ্ছে।
জুলাই চত্বর
এক্সিবিশন সেন্টারের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে জুলাই চত্বর, দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে কালচারাল সেন্টার, প্রযুক্তি কর্নার ও বিনোদন কর্নার রয়েছে। সেন্টারের উত্তর-পূর্ব পাশে শিশুপার্ক এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে ছত্রিশ চত্বর ও নামাজঘর স্থাপন করা হয়েছে।
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা
মেলার সার্বিক নিরাপত্তা এবং দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মেলা প্রাঙ্গণে পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত আছে। প্রাঙ্গণের বাইরেও নিয়মিত টহল দল রয়েছে। নিরাপত্তা অগ্রাধিকার বিবেচনায় মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান, প্রবেশপথ, পার্কিং এরিয়া ও সংশ্লিষ্ট সব এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসিটিভি স্থাপন করা হয়েছে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
এবারের মেলায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। এক্সিবিশন হলে পুরুষ ও নারীদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক আলাদা টয়লেটের পাশাপাশি এক্সিবিশন হলের বাইরেও পর্যাপ্তসংখ্যক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলায় খাদ্যদ্রব্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ গঠিত টিম মেলা চলাকালীন প্রতিদিন ভেজালবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন।
বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা
মেলায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসক উপস্থিত থেকে বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা ও চিকিৎসা পরামর্শ দেবেন। মেলায় পাঁচ শতাধিক গাড়ি পার্কিং সুবিধাসংবলিত দ্বিতল কার পার্কিং ভবন রয়েছে। এ ছাড়া মেলা কেন্দ্রের বাইরে আছে ছয় একর জমিতে পার্কিংয়ের আলাদা ব্যবস্থা।
তথ্যকেন্দ্র ও ব্যাংক বুথ
মেলার সার্বিক কার্যক্রম তদারকির জন্য মেলায় স্থাপন করা হয়েছে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও দর্শনার্থীদের সব ধরনের তথ্য দেওয়ার জন্য রয়েছে তথ্যকেন্দ্র। ব্যাংকিং সেবার জন্য মেলায় অনেক ব্যাংক বুথ স্থাপন করেছে। জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
টিকিটের দাম কত
মাসব্যাপী এই মেলা সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন খোলা থাকছে রাত ১০টা পর্যন্ত। মেলায় প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টিকিটের মূল্য ৫০ টাকা এবং ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের কার্ড দেখিয়ে বিনামূল্যে মেলায় প্রবেশ করতে পারবেন।