দেশব্যাপী তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। এক সপ্তাহ ধরে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাসাবাড়িতে চুলা জ্বলছে না। ঘুরছে না শিল্পকারখানার চাকা। ক্রেতা ধরে রাখতে ভর্তুকি দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় কারখানা চালু রাখছেন শিল্প মালিকরা। সিএনজি ফিলিং স্টেশনেও গ্যাসের চাপ নেই। গ্যাস নিতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন রাজধানীজুড়ে যানজট সৃষ্টি করছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে মাতারবাড়ির মহেশখালীতে একটি ভাসমান রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকায় এই সংকট বেড়েছে। এ কারণে ১ জুানয়ারি থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ১ হাজার থেকে ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ যুগান্তরকে বলেন, মহেশখালীর এফএসআরইউটি রোববার রাত থেকে চালু হয়েছে। তিনি বলেন, গ্যাসের সরবরাহ বেড়েছে। ২-৩ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, শীতের তীব্রতায় গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে। সংকটের পেছনে এটাও একটা কারণ। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে সরবরাহ রয়েছে ২৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।
পেট্রোবাংলাসহ জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গ্যাস সংকটের কারণে ২০২০ সালের এপ্রিলের পর এবারই দেশে গ্যাসের সরবরাহ সর্বনিম্ন। এই সরবরাহ ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসের গড় সরবরাহ থেকেও কম। জানা গেছে, ১ জানুয়ারি থেকে মহেশখালীতে অবস্থিত এক্সিলারেট এনার্জির ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি মেরামতের জন্য বন্ধ রাখা হয়। রোববার মেরামত শেষ হলে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে। আজকালের মধ্যে চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি সরবরাহ শুরু হবে। এতে গ্যাস সংকট সহনীয় হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। রাজধানীবাসী বলছেন, সকাল ৭টার দিকেই গ্যাস সম্পূর্ণভাবে চলে যায়। আসার ঠিক নেই। এরপর থেকে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। গ্যাসের চাপ কম থাকায় শুধু ডাল বা ভর্তা খেয়েই দিন পার করছেন অনেকে। মাছ বা মাংস রান্না করার মতো অবস্থা নেই। বর্তমানে বাসাবাড়িতে দিনে মাত্র ২-৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে। তাও বেলা ৩টার পর থেকে নিবুনিবু করে চুলা জ্বলা শুরু হয়। রাত ১২টার পর থেকে চুলায় কিছু গ্যাস আসে। সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতেও গ্যাসের অপেক্ষায় তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ লাইন। অন্যদিকে, শিল্পকারখানাগুলো সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চলছে। পুরোদমে চালানোর মতো চাপ নেই গ্যাসের সরবরাহ লাইনে।
গ্যাস সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের গার্মেন্টের মতো রপ্তানিপণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো। পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ না হলে তারা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সময়মতো অর্ডার সাপ্লাই করতে পারছে না। ফলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অর্ডার কমে যাচ্ছে। এই অবস্থা চললে ক্রেতারাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।জানা যায়, গাজীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানাসহ নানা ধরনের শিল্পকারখানা রয়েছে। আর এর বেশিরভাগই গ্যাসনির্ভর। এক থেকে দেড় মাস ধরে এসব কলকারখানায় গ্যাস সংকট চলছে। ক্রেতা ধরে রাখতে অনেকে ভর্তুকি দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় কারখানা চালু রাখলেও বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকটে শ্রমিকরা ঠিকমতো কাজের শিডিউল মেলাতে পারছেন না। শ্রমিকরা কারখানায় এলেও গ্যাসের চাপ না থাকায় তাদের বেকার সময় পার করতে হচ্ছে। এ সংকটের সমাধান না হলে শতভাগ রপ্তানিমুখী শত শত পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্যমতে, গ্যাস সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারখানার উৎপাদন। লাইনে গ্যাস কম থাকায় যন্ত্রপাতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কারখানার কার্যক্রম বন্ধ রাখছেন মালিকপক্ষ। বিটিএমএ গত সপ্তাহে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে শিল্প মালিকদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্যাস সংকটের কারণে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে টেক্সটাইল মিলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কাজ করছে।নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কোনাবাড়ী, শফিপুর, নরসিংদী, সাভার, আশুলিয়া, হবিগঞ্জ, মাওনা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অবস্থিত বিটিএমএর সদস্য মিলগুলোতে গত এক মাস ধরে গড় গ্যাসের চাপ (বর্গ ইঞ্চিপ্রতি-পিএসআই) শূন্য থেকে ২ পাউন্ডের মধ্যে রয়েছে। এই চাপ দিয়ে কোনোভাবেই কারখানা চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্সের কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্যাসের ঘাটতির কারণে নিট মিলগুলো প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে দেশের টেক্সটাইল শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ ১২ জেলায় তিতাসের গ্রাহকরা দৈনিক প্রায় ১৮০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস পেত। এখন মিলছে দেড়শ কোটি ঘনফুটের নিচে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছে, এমনিতেই শীতকালে লাইনে কনডেনসেট জমে গ্যাস সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়। তার ওপর সরবরাহ ঘাটতির কারণে সংকট প্রকট হয়েছে।বাসাবাড়ির মালিকরা বলছেন, গ্যাসের এই সংকটের কারণে তিতাসের লাইন থাকার পরও ভাড়াটিয়াদের চাপে তারা বাধ্য হচ্ছেন এলপিজি লাইন তৈরি করতে। এতে একদিকে তিতাসের গ্যাস বিল দিতে হচ্ছে অপরদিকে সিলিন্ডার গ্যাসও কিনতে হচ্ছে। তাদের খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। একটি গাড়ির গ্যাস নিতে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগছে।
শিল্প মালিকরা বলছেন, একদিকে ডলার ক্রাইসিসের কারণে কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। যথাসময়ে কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। বাড়তি দাম দিয়ে গ্যাস কিনছেন। কিন্তু এভাবে কিছুদিন পরপর গ্যাস সংকট চলতে থাকলে এই সেক্টর কিভাবে চলবে?এদিকে শীত শুরু হওয়ার পর থেকে সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে কমেছে গ্যাসের চাহিদাও। তার মানে এই নয় যে, বিদ্যুৎ খাতের বেঁচে যাওয়া গ্যাস অন্য খাতগুলো বেশি পাচ্ছে। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, এই গ্যাস সংকটের পেছনে দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়া একটা কারণ। পাশাপাশি এলএনজি আমদানির পরিমাণও কমেছে। নিকট-ভবিষ্যতে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও দেখতে পাচ্ছেন না তারা। তারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হবে।
সিরামিক শিল্পের অন্যতম প্রধান উপকরণই গ্যাস। ফলে চলমান সংকটে এই ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিও হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ফার সিরামিকস লিমিটেডের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তাদের কারখানায় গ্যাসের চাপ কমপক্ষে ১০ পিএসআই (চাপের একক) থাকতে হয়। কিন্তু দিনের বেলা বেশিরভাগ সময়ই চাপ থাকে দুই থেকে চার পিএসআই। ফলে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।নারায়ণগঞ্জের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা টোটাল ফ্যাশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গ্যাস সংকটে তাদের উৎপাদন কমেছে তিন ভাগের এক ভাগ। তারা শুধু শুক্রবারে গ্যাসের চাপ পান। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় ওই গ্যাস কোনো কাজে লাগে না। সপ্তাহের অন্যান্য দিনে তাদের বয়লার চালু রাখার মতো পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায় না। স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস সংকটে তাদের জ্বালানি চাহিদার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডিজেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে তাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। গ্যাস সংকটের কারণে বর্তমানে প্রতি টন রড উৎপাদন করতে খরচ বেড়েছে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, শেখেরটেক, পশ্চিম ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, মধুবাজার, ডেমরা, পূর্ব ডগাইর, হাজীনগর, কোলাটিয়া, পূর্ব শেওড়াপাড়া, মিরপুর, শ্যামলী, পল্লবী, বনশ্রী, গেন্ডারিয়া, নবাবগঞ্জ, নারিন্দা, মোহাম্মদপুর ও ভাষানটেকসহ পুরান ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় গ্যাসের সংকট দেখা গেছে।ভাষানটেক এলাকার প্রায় দুই হাজার ৫০ পরিবারের কারও বাড়িতে তিতাসের লাইনে গ্যাস নেই গত কয়েকদিন ধরে। বাধ্য হয়ে কেউ জ্বালানি কাঠ, আবার যাদের আয় ভালো তারা এলপিজি ব্যবহার করেছেন। গ্যাস থাকে রাত দেড়টা থেকে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। পশ্চিম ধানমন্ডি মধুবাজার এলাকার বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, গ্যাস না থাকায় তাদের রান্নার জন্য মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়। খালিদ হোসেন নামে আজিমপুর এলাকার এক বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, আগে প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেতে বাসায় আসতেন। এখন তাকে বাইরে খেতে হচ্ছে। কারণ গ্যাসের অভাবে তার স্ত্রী দিনের বেলা রান্না করতে পারছেন না।
শেখেরটেক এলাকার বাসিন্দা আদম মালেক নামে এক চাকরিজীবী যুগান্তরকে বলেন, চলমান গ্যাস সংকটে ভোররাত ৩টা পর্যন্ত তাকে রান্নার জন্য জেগে থাকতে হয়। ঘুমাতে পারেন না। গত এক সপ্তাহ ধরে অফিসে যেতে দেরি হচ্ছে। দিনে বেলা ৩টার আগে গ্যাস আসে না। রাত ১০টার পর চাপ কিছুটা বাড়ে।মতিঝিলের আরামবাগের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আগের সরকারের দুর্নীতির কারণে গ্যাস পাওয়া যায়নি। এখন তাহলে কী হচ্ছে। আমরা প্রতি মাসে বিল দিচ্ছি, কিন্তু পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছি না। আমাদের এলাকায় বেশিরভাগ বাড়িতে গ্যাসের সংযোগ আছে, তবে বাসিন্দারা এলপিজি ব্যবহার করছেন। একজন গ্রাহককে বাধ্য হয়ে দুবার বিল দিতে হচ্ছে। যাদের পক্ষে এলপিজির ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়, তাদের ভোররাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
উত্তরখানের মাদারবাড়ী এলাকার বাসিন্দা তাওহীদুল মাওলা বলেন, তাদের এলাকায় অনেকে ছাদ ও বাসার নিচে মাটির চুলা বানিয়ে রান্নার কাজ করছেন। আশকোনা হজ ক্যাম্প এলাকায়ও একই অবস্থা। এখানে বেশিরভাগ মানুষের বাসায় দুটি সংযোগ রয়েছে। একটি তিতাস গ্যাসের অপরটি এলপিজির। বেশিরভাগ গ্রাহক পুরো মাস এলপিজি ব্যবহার করলেও মাস শেষে তিতাস গ্যাসের দুই চুলার বিল পরিশোধ করছেন। পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) যুগান্তরকে বলেন, যে ভাসমান টার্মিনালটি সংস্কারের জন্য বন্ধ ছিল সেটি চালু হয়ে গেছে। এতে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। এরফলে সংকট কিছুটা কমবে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। সরকার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের পরিকল্পনা আছে। এই মুহূর্তে সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও তিনি জানান।