
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস নিয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে। রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, আমলা ও সংক্ষুব্ধ আসনের সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগের পাহাড়ে এই চাপ তৈরি হয়েছে। এতেই হিমশিম অবস্থা সাংবিধানিক সংস্থাটির।
জানা গেছে, সংসদীয় ৩০০ আসনের বিপরীতে মাত্র ৭৬টি আসন থেকে প্রায় ৭০০ অভিযোগ জমা পড়েছে ইসিতে। কয়েকটি আসন থেকে সর্বোচ্চ অভিযোগ এসেছে। এগুলো হচ্ছেÑঢাকার-১ ও (দোহার-নবাবগঞ্জ) ও ঢাকা-২ (কেরানীগঞ্জ, লালবাগ), কুমিল্লা-১০ (সদর দক্ষিণ-লালমাই-নাঙ্গলকোট), বরগুনা-১ (সদর, আমতলী ও তালতলী) বরগুনা-২ (বামনা-পাথরঘাটা ও বেতাগী) এবং পিরোজপুর-২ (কাউখালী-ভান্ডারিয়া-নেছারাবাদ) আসন।
অন্যদিকে দুই শতাধিক আসন থেকে একটিও আবেদন পড়েনি। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে ইসি। নির্বাচন কমিশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হলেও কিছু যৌক্তিক ছিল। এ ছাড়া এবার বিদ্যমান পদ্ধতির বাইরে আসনওয়ারি ভোটার সংখ্যা দিয়ে তথ্য যাচাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এর ফলে উপজেলার প্রশাসনিক ইউনিট বজায় রেখে সীমানাবিন্যাস সম্ভব হবেÑএমটাই মনে করছেন ইসিসংশ্লিষ্টরা।
ইসির তথ্যমতে, তিন পাবর্ত্য অঞ্চল ও গোপালগঞ্জ জেলা বাদে ২৯৭ সংসদীয় আসনে ২০০৮ সালে ব্যাপক ওলট-পালট করা হয়। এর মধ্যে ১২৯ আসনে আমূল পরিবর্তন এনেছিল তৎকালীন কমিশন। এমনকি জেলার আসন কমিয়ে ঢাকায় আটটি বাড়ানো হয় (যার মধ্যে ফরিদপুর, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, বরগুনা, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ), পৃথক দুটি সংসদীয় আসনকে ভেঙে একটি আসনে রুপান্তরিত করা, উপজেলাকে দ্বিখণ্ডিত করে প্রশাসনিক ইউনিটকে তছনছ করে ফেলা হয় এবং একটি ইউনিয়নকে দুটি সংসদীয় আসনে ভাগ করার নজির তৈরি করা হয়। এসব নিয়ে ওই সময়ে সংক্ষুব্ধরা শত শত অভিযোগ দিলেও তা আমলে নেয়নি এক-এগারোর সেনা সমর্থিত ড. শামসুল হুদা কমিশন। এরপর গত তিনটি কমিশন সীমিত পরিসরে আসনবিন্যাস করে নির্বাচন সম্পন্ন করেন।
এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুনর্গঠিত কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো ঘোষণা ছাড়াই সীমানা পুনর্বিন্যাস দাবি করে আবেদনের হিড়িক পড়ে। দেখা গেছে, প্রায় ১০০ আসনে পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য আবেদন জমা হয়। এগুলো নিষ্পত্তি করা নিয়ে হিমশিম অবস্থা ইসির। কারণ প্রতিদিনই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, সংশ্লিষ্ট আসনের সংক্ষুব্ধ নাগরিক, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি এবং সরকারের প্রভাবশালী আমলারা ইসিতে এসে কিংবা ওভার টেলিফোনে তার আসনটি বিন্যাস করার অনুরোধ জানাচ্ছেন। একইভাবে, কেউ পুনর্বিন্যাসের জন্য বেশ জোরাজুরিও করছেন। আবার কেউ কেউ ২০০১ সালের পুরোনো সীমানা বহাল করার পক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়ে কমিশনকে মোটিভেশন করার চেষ্টা করছেন।
ইসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য কমিশনারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুমিল্লার দাউদকান্দি আসনটি আগের অবস্থায় ফেরানোর জন্য দূতিয়ালি করে গেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে। একইভাবে, ফরিদপুরের একটি আসনের জন্য তদবির করে গেছেন বিএনপির কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল। আর ফেনী জেলা বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা তার এলাকার বিদ্যমান আসনটির সপক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়ে তদবির করে গেছেন।
নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানান, পক্ষে-বিপক্ষে তদবির আসছে প্রতিদিনই। কিন্তু আইন, বাস্তবতা ও আসনওয়ারি অবস্থান বিবেচনায় সংসদীয় আসনের সীমানা বিন্যাস করা হবে বলে জানান তারা।
সংসদীয় সীমানা বিন্যাস ইস্যুতে নানা মহলের তদবির ও চাপের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে কমিশন। সিইসি এএমএম নাসিরউদ্দিন ঈদুল আজহার ছুটি-পরবর্তী প্রথম কর্মদিবসে কর্মকর্তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ সময় সবাইকে সতর্ক করে সিইসি কড়া বার্তা দিয়ে বলেছিলেন, পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক তদবির আসবে। আমরা সবার কথাই শুনব। কিন্তু কেউ বিরাগভাজন হয়Ñএমন কোনো মন্তব্য করব না। কারো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। সবার জন্য যেটা কল্যাণ হবে এবং আমাদের বিবেচনায় সঠিক মনে হবেÑআমরা সেটাই করব। আমরা কারো পক্ষে-বিপক্ষে না, নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব।
কমিশন সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ জুন সিইসিসহ চার নির্বাচন কমিশনার এবং জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানে ইসির কর্মকর্তা কাউকে রাখা হয়নি। অনেকটা গোপনীয়তার স্বার্থে জিআইএস পদ্ধতিতে বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা ও প্রশাসনিক অখণ্ডতার আলোকে সীমানাবিন্যাস করার জন্য সংশ্লিষ্ট অ্যাপে তথ্য সন্নিবেশ করেন। এর পরই মূল চ্যালেঞ্জ ও অসুবিধার ধরা পড়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে। সভায় উপস্থিত একাধিক নির্বাচন কমিশনার আমার দেশকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে আবেদনগুলোর যৌক্তিকতা বিবেচনায় সিরাজগঞ্জ, বরগুনা ও ঢাকা জেলায় নূন্যতম একটি করে আসন বাড়ানোর খসড়া চূড়ান্ত করেছিল। এর বিপরীতে রাজশাহী, গাজীপুর ও ঢাকা মহানগরীর একটি আসন কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। একই সঙ্গে কিছু উপজেলার অখণ্ডতা দূর করে একক প্রশাসনিক ইউনিট করার উদ্যোগও ছিল ইসির। সব মিলিয়ে ২০টি সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস করার চিন্তা ছিল।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ আমার দেশকে বলেন, দু-তিনটি আসন বাড়ানো লাগতে পারে। তবে এটিও খসড়া। আরো পর্যালোচনা করতে হবে, এজন্য সময়ও লাগবে। তবে সর্বশেষ আদমশুমারির আলোকে সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন করা হলে নানা ধরনের আইনি মারপ্যাঁচে পড়তে পারে কমিশন। এ কারণে আরো যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইসি। বিদ্যমান আইনের বাইরে জিআইএস অ্যাপে এই প্রথম আসনওয়ারি বিদ্যমান ভোটার সংখ্যা দিয়ে ৩০০ সংসদীয় আসনের অবস্থান জানা ও বোঝার চেষ্টা করবে কমিশন। ২২ জুন থেকে এ পদ্ধতি নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করবে কমিশন।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমরা ভোগোলিক অবস্থান, আয়তন ও জনসংখ্যা দিয়ে জিআইএস পদ্ধতিসংক্রান্ত অ্যাপ দিয়ে তথ্য যাচাই করেছি। এ পদ্ধতিতে কিছুটা অসংগতি মনে হয়েছে। তাই এবার আসনওয়ারি ভোটার সংখ্যা দিয়ে আরেকটি পর্যালোচনা করতে চাই। আরো একটু অপেক্ষা করুন, সব জানতে পারবেন।
এদিকে গত ১৯ জুন কমিশন সভায় সীমানা আইনসংক্রান্ত এজেন্ডা ছিল। কিন্তু ভোটার সংখ্যা দিয়ে তথ্য যাচাই করার জন্য কমিশন সভাটি মুলতবি করা হয়। আগামী বৃহস্পতিবার বিকালে সীমানাসংক্রান্ত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য পুনরায় সভা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।