Image description

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে যেসব সদস্য গুম, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কিংবা প্রতিষ্ঠানগত জবাবদিহিতার মতো বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বা ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন, তাদের প্রায়শই ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। এমনই ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে গুম কমিশনের রিপোর্টে।

এতে বলা হয়, বিচারব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণের পাশাপাশি আরও দুটি বিষয় এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। তা হচ্ছে- দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ভেতরে একটি নীরব সহমতের সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে গড়ে ওঠা এমন একটি ঐকমত্য, যা ‘স্থিতিশীলতা রক্ষার’ অজুহাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ তৈরি করেছে। 
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয় বা কেবল কয়েকজন কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতার ফল নয়। এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ফল, যেখানে এসব অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে, স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরস্কৃতও করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয়পক্ষই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো ৫ই আগস্ট ২০২৪-এ সরকার পরিবর্তনের পরও এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি বহাল আছে এবং পূর্ববর্তী কাঠামো অনেক ক্ষেত্রে আগের মতোই কাজ করছে। 

কমিশনকে বয়স চল্লিশের কোঠায় একজন অফিসার জানিয়েছেন গুম বিষয়ে নিজস্ব মত প্রকাশ করা এবং তৎকালীন সরকার নির্ধারিত অবস্থান মেনে না চলার কারণে কীভাবে সহকর্মীদের কাছ থেকে তাকে পরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। প্রতিটি নতুন পোস্টিংয়ের আগেই তার সহকর্মীদের সতর্ক করে দেয়া হতো যাতে তাকে বিশ্বাস না করে। তার পরিবারিক যোগাযোগের ওপর নজরদারি করা হতো এবং তার বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ আনা হতো। যদিও তিনি কখনো কোনো ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গ করেননি, তথাকথিত অভ্যন্তরীণ তদন্ত এবং নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিলকরণের মতো প্রশাসনিক অস্ত্র ব্যবহার করে তার পেশাগত অগ্রগতি নষ্ট করে দেয়া হয়। ২০০৭-২০০৮ সময়কালে এক আওয়ামী লীগ নেতার দুর্নীতি তদন্তকারী টাস্ক ফোর্সের নেতৃত্ব দেয়া কর্মকর্তাকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর বরখাস্ত, জোরপূর্বক গুম, এবং পরে মনগড়া অভিযোগে কারারুদ্ধ করে। কমিশন জানায়, ডিজিএফআই-এর এক সাবেক ডিরেক্টর জেনারেল, যিনি ঘটনার সাক্ষী, ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এই ঘটনাটি একটি বৃহত্তর প্রবণতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তারা সদিচ্ছা থেকে নেয়া পদক্ষেপের জন্যও শাস্তির মুখোমুখি হন। ফলে, অনেক কর্মকর্তা দায়িত্বের অংশ হিসেবেও নীতিনিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে ভয় পান, কারণ তারা বিশ্বাস করেন সঠিক কাজ করলেও ভবিষ্যতে তাদের শাস্তি পেতে হতে পারে। অন্যদিকে এক তরুণ গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত তার ভাই কীভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সে অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তার ভাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল নিজ দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার সক্রিয় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করতে। পরে তিনি জানতে পারেন তিনি যে তালিকা জমা দিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেককে এলিমিনেট করা হয়। তার অপরাধবোধ এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে শেষ পর্যন্ত তাকে চরম মানসিক অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। 

কমিশনের রিপোর্টে উঠে আসে, বয়স পঁচিশের কাছাকাছি একজন তরুণ সৈনিককে যখন এক গোপন বন্দিশালায় পোস্টিং দেয়া হয়, তিনি সেখানকার পরিস্থিতি দেখে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন (বন্দিশালাটি বন্দিদের প্রতি নিষ্ঠুরতার জন্য বিশেষভাবে কুখ্যাত)। প্রাথমিক প্রশিক্ষণের সময়েই তাকে একটি স্থায়ী আদেশ দেয়া হয়, যা সেখানকার কর্মরত সবাই মেনে চলতো। সেটি হচ্ছে- ‘বন্দিদের সঙ্গে কখনো স্বাভাবিক আচরণ করা যাবে না, যেটা স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে করা হয়। তাদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে, সব অধিকার থেকে। যাতে সে কষ্ট অনুভব করতে পারে।’ এমনকি, প্রহরীরা নির্দেশিত ছিল যেন তারা বন্দিদের আশেপাশে কথা পর্যন্ত না বলে। পরিবর্তে, তাদের বলা হয়েছিল ইশারা ও শিষ ব্যবহার করতে। যখন তিনি ওই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইলেন, তখন তাকে সরাসরি হুমকি দেয়া হয় যে পিছু হটলে প্রাণ হারাতে হতে পারে। তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এ কথাটি অতিশয়োক্তি বলে ধরে নেয়া যায়, কারণ আমাদের কাছে এখনো এমন কোনো প্রমাণ নেই যে কেউ কেবল এ ধরনের দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বলে নিহত হয়েছে; বরং এমন পোস্টিংয়ে সৈনিক ও কর্মকর্তাদের নিয়মিত বদলি করা হতো। তবুও এই ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে: নিঃশব্দে এবং নিঃশর্তে মেনে চলাকেই শুধুমাত্র আনুগত্য বোঝানো হতো। কমিশনের তদন্তে এও উঠে আসে যে, ভেতরে ভেতরে ভিন্নমত টিকে ছিল। যেমন, সেই একই সৈনিক, যিনি দায়িত্ব ছেড়ে যেতে পারেননি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে নিজের অবস্থানকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। বন্দিদের জন্য যেহেতু প্রহরীদের অর্ধেক রেশন বরাদ্দ ছিল, তিনি নিয়মিত নিজের খাবার বন্দিদের দিয়ে দিতেন। সৈনিকটির দেয়া খাবার পেয়েছিলেন এমন ভুক্তভোগীর কাছ থেকেও কমিশন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে। অবশেষে পেট পুরে খেতে পেরে, এক বন্দি কান্নাভেজা চোখে একবার তাকে ধন্যবাদ জানায়। সৈনিকটি পাশে সরে গিয়ে নিঃশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার চোখে জলের কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি বাড়ির কথা মনে পড়ছে বলে পাশ কাটিয়ে যান। এই যন্ত্রণা তিনি একা অনুভব করেননি। এ ধরনের অপরাধে জড়িত থাকাটা অনেক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের ওপর মানসিকভাবে গভীর প্রভাব ফেলেছিল বলেও কমিশনের রিপোর্টে উঠে আসে। 

গুম কমিশনের অনুসন্ধানে সবচেয়ে বিস্ময়কর আরও একটি ঘটনা উঠে আসে। যেখানে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক সহকর্মী ৫ই আগস্টের পর গণভবনে পরিত্যক্ত কিছু নথিপত্র পর্যালোচনা করতে গিয়ে দুটি হাতে লেখা চিঠি আবিষ্কার করেন যা র‌্যাবের দু’জন কর্মকর্তা বেআইনি আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইন্টিলিজেন্সের পরিচালক বরাবর লিখেছিলেন। কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি না, বরং ব্যক্তিগত ঘোষণাপত্র ছিল; তবুও স্পষ্টতই এগুলো শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। তিনি এগুলো ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের ফাইলে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।