Image description

রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় অন্য বছরের তুলনায় এবার ফারাক্কা দিবস (১৬ মে) উদ্‌যাপন যথেষ্ট দৃশ্যমান ছিল। উৎসাহী, অতি উৎসাহী, কম উৎসাহী, হুজুগে উৎসাহী—প্রায় সবাই শামিল হয়েছিলেন ফারাক্কা দিবস উদ্‌যাপনে। ফটোসেশন হয়েছে।

ঢাকা ছাড়া রাজশাহীতে সভা-সমাবেশ-সেমিনার হয়েছে। ঢাকা থেকে এক দিনের ট্রিপে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন অনেকে। এসবই খুব উৎসাহের কথা। উদ্‌যাপন ‘পছন্দ’ মানুষের দেশে এটাই স্বাভাবিক। চোখের বা শরীরের অন্য কোনো পানি দিয়ে ফারাক্কা সমস্যার যে সমাধান সম্ভব নয়, এটা কি আমরা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো করে আত্মস্থ করতে পেরেছি? আহমদ ছফা বলতেন, ‘ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে বাংলাদেশের যে সর্বনাশ ঘটছে, এটা তাঁর (ভাসানীর) চেয়ে স্পষ্ট করে কেউই বোঝে নাই।’

অনেকেই মনে করেন, ফারাক্কার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (২১ এপ্রিল, ১৯৭৫) আমন্ত্রণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের না যাওয়াটা ‘বেয়াদবি’ হলেও সে দিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় মাওলানা ভাসানীর কথা শুনেছিলেন। মূলত ভাসানীর অনুরোধে তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে যাত্রা বাতিল করতে বলা হয়েছিল। ভারতের রাষ্ট্রদূত দুঁদে কূটনীতিক সমর সেন বিস্মিত হয়েছিলেন শেষ মুহূর্তের সেই সিদ্ধান্তে। মুখে কিছু না বললেও সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ভারতের কৃষি ও সেচমন্ত্রী জগজীবন রাম যে বেজার হয়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একাত্তরে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী; হয়তো সেই সুবাদে তাঁর ধারণা ছিল, ওদের ডাকলেই চলে আসবে।

মাওলানা সাহেবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কী কথা হয়েছিল, তার কোনো রেকর্ড নেই। তবে অনুমান করা যায়, তিনি তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের সেই বৈঠকের কথা। যেখানে দুই প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছিলেন যে শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগির বিষয়ে দুই দেশ একটি চুক্তিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করা হবে না। (সূত্র: Rameez Mohd Bhat, International Journal of Applied Research 2020; 6 (2): 264-268 Hydro-politics between India and Bangladesh: A study of Farakka barrage dispute)

পদ্মায় পানিপ্রবাহ না থাকায় শুকনো মৌসুমে বিশাল এলাকা চর পড়ে যায়। রাজশাহী নগরের তালাইমারী এলাকায় পদ্মা নদীতে
পদ্মায় পানিপ্রবাহ না থাকায় শুকনো মৌসুমে বিশাল এলাকা চর পড়ে যায়। রাজশাহী নগরের তালাইমারী এলাকায় পদ্মা নদীতেফাইল ছবি

সেই ঐকমত্যকে সম্মান না করে ভারত একতরফাভাবে ব্যারাজ খুলে দিতে পারে না। আর খুলে দেওয়ার সেই অনুষ্ঠানের সাক্ষী হওয়া মানে আমাদের পানির অধিকার থেকে পিছু হাঁটা। মাওলানা হয়তো মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে গঙ্গা নিয়ে ভারতের সঙ্গে প্রথম বৈঠকের কথা। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় দুই দেশে পানিবণ্টন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পরই ফারাক্কা চালু হবে। (সূত্র: প্রাগুক্ত) এরপর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দুই দেশের বেশ কয়েকটি বৈঠক হলেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধের জেরে পানিবণ্টনের বিষয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি।

ছিয়াত্তরে মাওলানা ভাসানী নব্বই পেরিয়ে গেছেন। বেশির ভাগ সময় থাকেন হাসপাতালে। সেই বছর পয়লা বৈশাখেও (১৫ এপ্রিল) তিনি হাসপাতালে ছিলেন। রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে শাহবাগে এসে তখনকার তরুণ উদীয়মান গায়ক ফকির আলমগীর বললেন, ‘চল হুজুরকে সালাম দিয়ে আসি।’ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদেই হোক বা ভক্তি থেকেই হোক, তিনি সব সময় মাওলানা ভাসানীকে ‘হুজুর’ বলতেন। মাওলানা ভাসানী ঘুমিয়ে ছিলেন। মনে হলো খুবই ক্লান্ত একটা শরীর অনেক বিশ্রাম চাইছে।

সত্তর সালে মনপুরার ‘রিলিফ লঞ্চে’ (সত্তরের সাইক্লোনে বিধ্বস্ত জনপদে ত্রাণ তৎপরতা) প্রথম দেখা মাওলানার সঙ্গে হাসপাতালে শুয়ে থাকা মাওলানার কোনো মিল দেখলাম না। একটা প্রাণবন্ত বড় আঙুর যেন নিমেষে কিশমিশ হয়ে গেছে। কদিন পর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তাঁর ভেতরের সিংহটা যেন জেগে উঠল। মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দিলেন ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে তিনি লংমার্চ করবেন। তাঁর এই কর্মসূচি তখন অনেককে বেশ চমকে দিয়েছিল। এটাকে অনেকেই বলেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ‘স্টান্টবাজি’। আদতে এটা ছিল তাঁর শেষ জানবাজি সংগ্রাম। দৈনিক সংবাদ-এর প্রতিনিধি মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন সেই মিছিলে (১৬ মে, ১৯৭৬)। পরদিন সংবাদ-এ তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন, লংমার্চের ৬৪ কিলোমিটার যাত্রা ছিল বেশ কঠিন। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ছিল মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে। এমনিতেই তাঁর বয়স ৯০ বছরের বেশি। মোনাজাতউদ্দিনের স্মৃতিচারণামূলক লেখা পথ থেকে পথে বইয়ে (১ জানুয়ারি, ১৯৯১) সে কথা তিনি আবারও উল্লেখ করেছিলেন।

১৯৭৬ সালের ২৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে লংমার্চ সফল করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। এই লংমার্চের আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লেখেন মাওলানা ভাসানী। সেই চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে লংমার্চের পূর্বাপর কারণ বর্ণনা করেন মাওলানা। এসব কর্মকাণ্ড থেকে অনুমান করা যায়, লংমার্চ কোনো চমক দেখানোর কর্মসূচি ছিল না। ইতিহাসের অংশ সেই চিঠি আজকের তরুণদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। (সূত্র: ১. বিবিসি বাংলা প্রতিবেদন, ঢাকা ১৬ মে ২০২২; ২. মহসিন শাস্ত্রপাণি/বুলবুল খান মাহবুব সম্পাদিত ‘মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী স্মারক-সংকলন’; ৩. এম গোলাম মোস্তফা, আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন কর্তৃক লিখিত প্রতিবেদন, ১৯৭৬-এর ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ, ১৪ মে ২০২৪)

১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তাঁর ভেতরের সিংহটা যেন জেগে উঠল। মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দিলেন ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে তিনি লংমার্চ করবেন।

মাওলানা ভাসানীর সেই লংমার্চ আসলে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপনের একটা পটভূমি তৈরি করে। পরে জাতিসংঘের ৩১তম অধিবেশনে জিয়াউর রহমান ফারাক্কার বিষয়টি উত্থাপন করেন। জাতিসংঘ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের পরামর্শ দেয়। মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালে ভারতে প্রথম অ-কংগ্রেস সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়। সে বছর গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে পাঁচ বছরের চুক্তি হয়।

এরপর আরও চুক্তি হয়েছে। চলমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে স্বাক্ষরিত মোট পাঁচটি চুক্তি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের পানির হিস্যা ক্রমেই কমেছে। এ ছাড়া উপমহাদেশে অন্যান্য পানিবণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে দেশগুলোয় নদীর মোট প্রবাহকে বিবেচনা করা হয় এবং উজানে নদীর ওপর নির্মিত সব ব্যারাজ, ড্যাম বা বাঁধের তথ্য ভাটির দেশকে দেওয়া হয়। এমনকি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সিন্ধু চুক্তিতেও বিষয়টি অনুসরণ করা হয়েছে। কিন্তু গঙ্গা চুক্তির ক্ষেত্রে বিষয়গুলো উপেক্ষা করা হয়েছে।

তিনি আরেকটি কথা বলেছিলেন, ‘নদীর একটা হক আছে; সাগরের সঙ্গে তার দেখা করার হক না দিলে দুনিয়া খাঁ খাঁ হয়ে যাবে। মখলুকাত ধ্বংস হয়ে যাবে। ফানা ফিল্লা হবে।’

ভারত বাংলাদেশকে শুধু ফারাক্কা ব্যারাজের পানির তথ্য প্রদান করে। যদিও গঙ্গার উজানে আরও একাধিক ব্যারাজ ও ড্যাম নির্মাণ করে ফারাক্কা পর্যন্ত গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে/হচ্ছে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের উজানের রাজ্যগুলোও ফারাক্কা নিয়ে তাদের টেনশন চেপে রাখতে পারছে না। গঙ্গার পানির প্রতি তাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। যার অর্থ হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে আমাদের হিস্যা আরও কমবে বই বাড়বে না। কিন্তু আমাদের পানির প্রয়োজন বাড়ছে। শুধু সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পদ্মার শাখা গড়াই, কুমার, মধুমতীতে বান ডাকা পানি লাগবে। সে পানির সুরাহা হতে পারে আমাদের পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি আর পানির সাশ্রয়ী ব্যবহারে।

অবশ্য ফারাক্কা দিবসের আলোচনায় ভারত আমাদের চাহিদামতো পানি না দিলে আমরা নিজেদের শক্তিতে কী করতে পারি, সেটার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।

মাওলানা ভাসানীর লংমার্চের সমাপনী ভাষণে (১৭ মে, ১৯৭৬) জানিয়েছিলেন, ‘ফারাক্কা সমস্যার সমাধানের জন্য ভারত যদি বাংলাদেশের মানুষের দাবি উপেক্ষা করে, তাহলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হবে।’ সে দিন এই লেখক নিজেও মাওলানার কথা শুনেছিলেন। তিনি আরেকটি কথা বলেছিলেন, ‘নদীর একটা হক আছে; সাগরের সঙ্গে তার দেখা করার হক না দিলে দুনিয়া খাঁ খাঁ হয়ে যাবে। মখলুকাত ধ্বংস হয়ে যাবে। ফানা ফিল্লা হবে।’ ভাষণের এই কথাগুলো পরের দিনের কোনো সংবাদপত্রে সেভাবে ছাপা হয়নি।

গঙ্গার পানির প্রতি তাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। যার অর্থ হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে আমাদের হিস্যা আরও কমবে বই বাড়বে না।

মোনাজাতউদ্দিনের বই বা সেদিনের মিছিলের অন্যতম সাক্ষী জাতীয় কৃষক সমিতির সাবেক দপ্তর সম্পাদক আবু নোমান খান রচিত প্রবন্ধ মাওলানা ভাসানীর জীবনস্রোত (মহসিন শাস্ত্রপাণি/বুলবুল খান মাহবুব সম্পাদিত মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী স্মারক-সংকলন বইয়ে প্রকাশিত) লংমার্চের অনেক খুঁটিনাটি থাকলেও ‘নদীর হকের’ কোনো বয়ান নেই। রাজশাহী বেতারের তদানীন্তন কর্মকর্তা জনাব হাসান মীর (গত বছর প্রয়াত) এই লেখককে বলেছিলেন, ‘আমরা আসলে কথাটার মানে বা ইমপ্লিকেশন বুঝতে পারিনি। তাই বেতারের খবরে সেটা জায়গা পায়নি।’ ‘পণ্য বয়কটের’ ঘোষণা বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে নদীর হকের কথা তিনি কয়েকবার উচ্চারণ করেছিলেন।

নদীর হক কী

এই প্রকল্পের আগে ২০১১ সালে রাজশাহীর শ্যামপুরে ১০৩ কোটি টাকার পানি শোধনাগারটি পদ্মায় পানি না থাকায় বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে।

দেখলাম গোদাগাড়ী উপজেলার সারাংপুর এলাকায় পদ্মা নদীর যে জায়গায় পানি শোধনাগার বসানো হচ্ছে, সেখানে ভারত থেকে গঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পদ্মা নাম নিয়েছে। এখান থেকে আবার পদ্মার শাখা নদী হিসেবে বেরিয়ে গেছে মহানন্দা। এই দুই নদীর মোহনায় ওয়াসার এই পানি শোধনাগার বসছে।

শুধু রাজশাহী নয়, পদ্মার পানি উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে ঢাকা নগরবাসীর জন্য। এর জন্য বসেছে ২০১৯ সালে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার।

আজকাল যে বলা হয় নদী একটি জীবন্ত সত্তা, সেদিন মাওলানা সে কথাটাই বলেছিলেন। পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে, ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দেশের উচ্চ আদালত একটি রায়ে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ (লিভিং এনটিটি) বলে আদেশ দেন। এর অর্থ মানুষের মতো নদীরও সুস্থ সুন্দর থাকার অধিকার রয়েছে। দখল দূষণ ভরাটের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে রয়েছে আইনি অধিকার। আদালতের নির্দেশনার ৪৩ বছর আগে নদীর হকের মাধ্যমে মাওলানা সে কথাই বলেছিলেন।

ফারাক্কা দিবসের আলোচনায় কেউ টুঁ শব্দ করেনি নদীদূষণ আর নদীর হক মেরে পদ্মার পানি উত্তোলন নিয়ে। শুধু রাজশাহী মহানগরবাসীর জন্য প্রতিদিন ২০ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের মেগা প্রকল্প চালু হয়েছে গোদাগাড়ীতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সরোয়ার জাহান জানালেন সে কথা। বিগত সরকার ২০২১ সালের ২১ মার্চ চীনের এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই প্রকল্প স্থাপনের চুক্তি করে। প্রতিদিন এই পরিমাণ পানি উঠিয়ে নিলে পদ্মা তো পাবনা পর্যন্তই পৌঁছাতে পারবে না। রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও পানি লাগবে। সেখানে প্রতিদিন কত কোটি লিটার লাগবে, তার পরিমাণ কোথায়?

 

খুলনা মহানগরী কেন বসে থাকবে? তারাও পদ্মার শাখা নদীর ওপর ভাগ বসাচ্ছে। মধুমতীর পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খুলনায়। এখন খুলনা নগরের সুপেয় পানির প্রায় ৫৩ শতাংশ চাহিদা মেটাচ্ছে মধুমতী একা। এ প্রকল্পের আওতায় খুলনা শহর থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরের মধুমতীর পানি পাইপের মাধ্যমে নিয়ে এসে খুলনার সামন্তসেনা এলাকায় পরিশোধন করা হয়। দৈনিক ১১ কোটি লিটার পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শোধনাগারের পাশাপাশি অপরিশোধিত পানি সংরক্ষণের জন্য ৭ লাখ ৭৫ হাজার কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতার একটি জলাধার নির্মাণ করা হয়। এতে নগরবাসীর জন্য তিন মাসের পানি মজুত থাকে। ২০১৯ সালের জুন থেকে এই প্রকল্প পুরোদমে কাজ করছে, আর মধুমতী মরছে।

মধুমতির পানি শোধনাগার
মধুমতির পানি শোধনাগারছবি: সংগৃহীত

আরও আগে ২০০০-০১ সালে গোপালগঞ্জ শহরের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য মধুমতী নদীর পানি উত্তোলন, শোধন ও সরবরাহকাজ শুরু হয় মানিকহার এলাকায়। এটা ছিল প্রথম পানি শোধনাগার; একই এলাকায় দ্বিতীয় পানি শোধনাগারটি বসে ২০১৯-২০২০ সালে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না পদ্মার শাখা নদ–নদী গড়াই, কুমার, মধুমতী ছাড়া সুন্দরবনে মিঠাপানি পৌঁছানোর আর কোনো পথ নেই। প্রয়োজনের মিঠাপানি না পেলে সুন্দরবন বাঁচবে কীভাবে?

পদ্মাকে বাঁচানোর কোনো পথ নেই?

নগরের প্রয়োজনে পদ্মার পানি ওঠানোর ঝোঁক সামাল দিতে হবে। পদ্মার হক সাগরের সঙ্গে মিলনের অন্তরায় তৈরি করা যাবে না। পদ্মাকে তাজা রাখার আরেকটি জিয়ন কাঠির গল্প পাকিস্তান আমল থেকেই শোনা যেত ‘গঙ্গা/পদ্মা ব্যারাজ’।

১৯৬১ সাল থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ চলছে। ১৯৭০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গঙ্গা ব্যারাজের প্রাথমিক কাজের জন্য ৫ কোটি টাকা (রুপি) বরাদ্দ করেছিলেন। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আড়াই মাইল ভাটিতে এই ব্যারাজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে গঙ্গা ব্যারাজ সার্কেল গুটিয়ে ফেলা হয়। ফারাক্কার ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে ১৯৮০ সালে জেনারেল জিয়া কুষ্টিয়ার তালবাড়িয়ায় এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। পরে বেশ কয়েকটি সমীক্ষার পর পাংশায় গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশমালায় বলা হয়, গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গড়াইসহ ১৬টি নদ–নদী নাব্যতা ফিরে পাবে; সেই সঙ্গে দূর হবে এই অঞ্চলের লবণাক্ততার আগ্রাসন এবং ফিরে আসবে ফারাক্কার প্রভাবে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

রাজশাহীর গোদাগাড়িতে পদ্মা থেকে পানি উত্তোলন কেন্দ্রের অবস্থান
রাজশাহীর গোদাগাড়িতে পদ্মা থেকে পানি উত্তোলন কেন্দ্রের অবস্থানছবি: লেখকের সৌজন্যে

ব্যারাজের দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ২ দশমিক ১ কিলোমিটার। পাবনার সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ও নদীর ডান তীর অর্থাৎ নদীর ওপারে রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার হাবাসপুর পর্যন্ত। এই ব্যারাজ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের সরাসরি সড়ক সংযোগ স্থাপন করবে বলে উল্লেখ করে সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যারাজের ডেকের ওপর স্থাপিত চার লেন বিশিষ্ট সড়ক সেতু বা প্রান্তে সাত কিলোমিটার সংযোগ সড়কের মাধ্যমে ডান প্রান্তে পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া মহাসড়কের সঙ্গে ৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের মাধ্যমে যুক্ত করবে।

ব্যারাজটি হবে নীলফামারীর ডালিয়ায় নির্মিত তিস্তা ব্যারাজের আদলে। ব্যারাজ থেকে উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকবে বিশাল রিজার্ভার। যার পানি ধারণক্ষমতা থাকবে ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই পরিমাণ পানি থেকে ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ২ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি সরবরাহ করা হবে। কিন্তু লাগবে ‘সাত মণ ঘি’। ঘি জোগাড়ের আমল না করে ফারাক্কা মিছিলের স্মৃতিচারণায় পদ্মাকে বাঁচানো যাবে কি? যেকোনো নাগরিককে প্রয়োজনে পদ্মার এক লিটার পানি উত্তোলনের আগে ভাটির জেলাগুলোর কথা ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সুন্দরবনের কথা। আর পদ্মার মায়ের সাগরের সঙ্গে মিলনের অধিকারের কথা। নদী মেরে সভ্যতা বাঁচে না, এটা না বুঝলে আমরা সভ্য হই কীভাবে?