Image description

সাফওয়াত বিনতে সলিাম (Safwat Binte Salam)

আমার আব্বুর প্রতি আমার অনেক রাগ:
আমার ছোটবেলা থেকেই বাবার প্রতি অনেক রাগ। এই রাগের শুরু আমার মায়ের কষ্ট দেখে। আমার বাবা যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখনও আমাদের জীবনটা অন্য সবার মতো সহজ ছিল না। আম্মু আমাদের জন্য রাজা সিটি বাসের ১০ টাকার টিকিটের বান্ডিল কিনে রাখতেন। আমি আর আমার বড় বোন সকালে বাসে করে আরামবাগ নামতাম, তারপর ২০ টাকার রিকশা ভাড়া দিয়ে স্কুলে যেতাম। মাঝে মধ্যে হেঁটে যেতাম।
আমার বাবা মন্ত্রী হিসেবে সরকার থেকে দুটি গাড়ি পেয়েছিলেন। একটি তিনি নিজে ব্যবহার করতেন, আর অন্যটি বেশিরভাগ সময় ব্যবহারই করা হতো না, কারণ তেলের খরচ বাবদ টাকা লাগবে। লোকজন বলত, "মন্ত্রীর মেয়ে হয়েও সরকারি স্কুলে পড়ে!" পরবর্তীতে আমাদের ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ভর্তি করানো হলেও তিন মাসের বেশি সেই খরচ বহন করা সম্ভব হয়নি। তাই আবার আমরা আগের স্কুলে ফিরে আসি।
আমার বাবা ছিলেন শিক্ষা, শিল্প ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী। শুনেছি, তখন একটি বড় কোম্পানি তাকে ৩০% শেয়ার দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি তা নেননি। এমনকি, আমাদের জন্য দুটি ফ্ল্যাট দেওয়ার প্রস্তাবও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আজকে যখন ভাবি, তখনও বাবার সিদ্ধান্তগুলো বুঝতে কষ্ট হয়।
বাবা যখন জেলে গেলেন, আমরা তখন খুব ছোট। আমার বোনের সামনে এসএসসি পরীক্ষা, আর আমি মাত্র ক্লাস সেভেনে উঠেছি। মা আমাদের নিয়ে সরকারি কোয়ার্টারে উঠলেন, কারণ আমাদের থাকার আর কোনো জায়গা ছিল না। বাবার মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি আমাদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি—এমনকি একটা বাসাও না।
আমার মা ছিলেন একজন সংগ্রামী মানুষ। তিনি একা আমাদের দুই বোনকে বড় করেছেন। আম্মু সারাজীবন চেষ্টা করেছেন আমাদের যতটা সম্ভব ভালোভাবে রাখার। কিন্তু একজন মহিলা মানুষ আর কতটা করতে পারেন? বাবার অনুপস্থিতিতে তিনি বদলি হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরেছেন। এমনকি, তাকে নিয়মিত অপমান করা হয়েছে। শেষপর্যন্ত, তাকে এমনভাবে সাসপেন্ড করা হয়, যাতে তিনি তার পেনশন ফান্ডটুকুও না পান। ICT মামলা করা হয় আম্মুর নামে । এমনও ঈদ গিয়েছে যেখানে বাবা জেলে আর মা পলাতক । ঈদ এর জামা তো বাদই দিলাম! সেমাইটাও কপালে জোটে নাই।
আমরা দীর্ঘ ১৬ বছর একটি কলোনির বাসায় থেকেছি। সেই বাসাটিকেও আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্য মামলা করা হয়েছিল। আমি এখনও মনে করতে পারি, এসএসসি পরীক্ষার সময় ভয় পেতাম, পরীক্ষার পর বাড়ি ফিরে যদি দেখি মা রাস্তার ধারে বসে আছেন বাক্স-পেট্রা নিয়ে? এমন ভয় নিয়ে আমি কীভাবে পড়তাম? এই সময়গুলোতে বাবার প্রতি রাগ আরও বাড়ত। ভাবতাম, কেন আমাদের এত কষ্ট করতে হয়? কেন আমার বাবা আমাদের জন্য কিছুই করেননি? কেন আমাদের এই অবস্থা হলো?
মা আমাদের দুই বোনকে কোনোভাবে প্রাইভেটে পড়িয়েছেন। সরকারি জায়গায় আমাদের নিরাপত্তা ছিল না। আমার সেই সময়কার রাগ, কষ্ট, অপমান আজও ভুলতে পারি না। মেডিকেলে থাকার সময় যখন আন্দোলন হতো( নিরাপদ সড়ক আন্দোলন), তখনও আমাকে "রাজাকারের মেয়ে" বলে ডাকত আমারই সিনিয়ররা। আমাকে নিয়ে পোস্ট করা হতো, হাসাহাসি করা হতো। এসব অপমান সহ্য করেও নিজের জীবন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছি।
বাবা যখন জেল থেকে ফিরলেন, তখন আমরা বুঝলাম তার চিকিৎসা করাতে হবে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। অনেক অনুরোধ করলাম, যেন একটি ভালো প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু বাবা রাজি হলেন না। বললেন, এত খরচ তিনি দিতে পারবেন না, আর আমরা যেন দিই—সেটাও চান না। তিনি যুক্তি দিলেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেখানে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, সেখানে তিনি কেন পারবেন না?
এখানেই আমার মনের একটি গভীর উপলব্ধি হলো। সততার পথ বেছে নেওয়া মানুষগুলো যেমন তাদের প্রাপ্য মর্যাদা পান না, তেমনি তাদের সন্তানরাও। আমি একজন চিকিৎসক হয়ে বাবাকে একটি ভালো ফোন, ভালো গাড়ি বা উন্নত চিকিৎসা দিতে পারছি না। কারণ সৎ মানুষের জন্য জীবনটা সত্যিই কঠিন।
কিন্তু আজ এতগুলো বছর পর, বাবার প্রতি সেই রাগটা আর নেই। বরং, যখন দেখি, আমার বাবাকে কেউ টাকার লোভ দেখিয়ে কিনতে পারেনি, তখন গর্ব হয়। যখন দেখি, দুই দিনের রাজনীতিবিদরা তিন দিনের মধ্যে প্রাসাদ বানিয়ে ফেলেন, প্রাডোতে চড়ে ঘোরেন, তখন আমার বাবার সততা আমাকে গর্বিত করে। বাবা হয়তো আমাদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারেননি, কিন্তু তিনি যা রেখে গেছেন, তা হলো সততার এক অনন্য উদাহরণ।
আমার মা বলতেন, "সৎ মানুষের জন্য পৃথিবীটা খুব কঠিন।" আমি আজ বুঝি, সত্যিই এই পৃথিবী সৎ মানুষের জন্য অনেক কঠিন। অসাধারণ হওয়ায় কোনো মহত্ত্ব নেই, সাধারণ মানুষের মাঝে অসাধারণ হয়ে উঠতেই আসল গৌরব। আমার বাবা সেটাই শিখিয়ে গেছেন।
সততার পথ বেছে নেওয়া কঠিন, কিন্তু এর গৌরব চিরস্থায়ী।