Image description

বিগত সরকার শাসন ব্যবস্থা দির্ঘায়িত করতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে গুম করা হয়েছে বলে দাবি করেছে গুম সংক্রান্ত কমিশন। এমনকি বিগত সরকার সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দিয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।

আজ বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) সকালে রাজধানীর গুলশানে গুম সংক্রান্ত কমিশনের কার্যালয়ে সভাপতি ও সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ কথ বলেন।

তিনি বলেন, বিগত সরকারের শাসনামলে গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। ‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ অভিযানের নামে সরকার ইসলামী উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে গুম করা হয়েছে। গুমের শিকার হয়েছে মেধাবী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি পেশাজীবি ও সাধারণ জনগণ।

তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়ায় তারা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করেছে এবং নির্যাতন ও গোপন আটকের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে, এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দিয়েছে।

তিনি বলেন, গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও বহু অপরাধী ও তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের অবস্থানে থাকায় অনেক জোরাল প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস, অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানারকম ভীতিকর ও আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবুও বহু ভুক্তভোগী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে সে কাহিনী তুলে ধরেছেন।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর কথিত ‘আয়না ঘর’ নামে বন্দিশালার স্থান-স্থাপনা পরিদর্শন করে কমিশন। সারা দেশে মোট ১৬টি গোপন বন্দীশালা পরিদর্শন করে কমিশন। গত ৪ ডিসেম্বর, ২৬ ফেব্রুয়ারিও ২৫ মার্চ তিনটি চিঠিতে মোট ১৩১টি অভিযোগের বিষয়ে আইজিপিকে মামলা করার জন্য বলেছে কমিশন।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের ৪ পরিণতি

কমিশনে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, গুমের শিকার ভিকটিমের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছে-প্রথমত তাদের হত্যা করা হয়, দ্বিতীয়ত তাদের কাউকে কাউকে বিচারের আগেই মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে বাংলাদেশেই বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারী মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়, তৃতীয়ত কাউকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা হয় এবং কারও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন এই প্রতিবেদনে প্রায় ১৮৫০ অভিযোগ বিশ্লেষণের মধ্যে থেকে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, যাদের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে—নিখোঁজ হওয়ার সময়ে তাদের নিকটাত্মীয়ের দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি, ফৌজদারি মামলা, গুম থাকাবস্থায় সংবাদ প্রতিবেদন এর মতো সমসাময়িক প্রমাণ রয়েছে।

শুধুমাত্র এই ২৫৩ জন সমসাময়িক প্রমাণ দাখিল করতে সক্ষম হয়েছেন, বাকিরা হননি কারণ তখন এসব ক্ষেত্রে জিডি করতে গেলে জিডি নেয়া হত না। ২৫৩ জনের মধ্যে অনেককে গুমের পর রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়েই প্রশ্ন করা হয়েছে। এমনকি অল্পকিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও দলীয় কোন্দল বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে গুম করা হয়েছে।

সেনাবাহিনী দায়ী নয়

সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (ডব্লিউজিইআইডি) এর একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। তারা ঘুম সংক্রান্ত কমিশন সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দুজন কর্মকর্তা একটি সংবাদ সম্মেলনে তাদেরকে জানিয়েছে গুমের ঘটনাগুলো তারা জানতো না।

এ বিষয়ে কমিশনের সভাপতি এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গুমের ঘটনার সঙ্গে সেনাবাহিনীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী করা যায় না। কারণ ডিজিএফআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীর কাছেই জবাবদিহি করত, সে দিক বিবেচনা করলে গুমের ঘটনায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীকে দায়ী করা যায় না। তবে ডিজিএফআইতে কর্মরত-কর্মকর্তারা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌ বাহিনীর ছিলেন। অর্থাৎ কর্মকর্তারা বিষয়গুলো জানতেন। এনএসআইও ঠিক সেরকম। তবে এই সংস্থাতেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসেন।