
সন্ধ্যা পৌনে ৬টা। ০১৩৩৭৫৪১৪০৩ মোবাইল নম্বর থেকে কল আসে দেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের কাছে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি ফোন দিয়েই বলেন ‘কেমন আছেন’। অপরিচিত মোবাইল নম্বর আবার কণ্ঠও অপরিচিত। তাই সম্পাদক তাকে বললেন, ‘আপনি কে? আপনার পরিচয় কী? কেন ফোন দিয়েছেন?’ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয় ‘আমি পুলিশ অফিসার ফারুক হোসেন বলছি, আপনার ছেলের সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়েছে তাই কথা বলা’ তখন সম্পাদক কিছুটা বিব্রতবোধ করে বলেন, ‘আমার ছেলে কোথায় থাকে জানেন? তার সঙ্গে আপনার ঝামেলা হবে কেন? প্রতারণা করার জন্য ফোন দিয়েছেন? ব্ল্যাকমেইল করার আর জায়গা পাচ্ছেন না? এসব কথা শুনে ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তি কল কেটে দেন।
শুধু ওই সম্পাদক নন। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে এভাবে প্রতারণা করার জন্য রাজধানীসহ সারা দেশে বেশ কিছু চক্র গড়ে উঠেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ রাহি। থাকেন রাজশাহীতে। তার বাবা থাকেন কুড়িগ্রামে। গত রমজানের ইফতারের ঠিক আগ মুহূর্ত। হঠাৎ একটা ফোনকল আসে রাহির বাবার কাছে। রাহির বড় ভাই আহসান হাবিব রাভি বলেন, আব্বু চিৎকার করে উঠলো- তোমার কাছে মাদক মানে! আব্বুর কাছে গেলাম। আব্বু ফোনে কথা বলছে। ফোন লাউড স্পিকারে দিলাম। অপরপ্রান্ত থেকে জানানো হচ্ছে, রাহিকে ছাড়াতে হলে ২২ হাজার টাকা চার্জ দিতে হবে এখনই। রাভি বলেন, আমি ফোনটা নিলাম। অপরপ্রান্তে পুলিশের গাড়ির সাইরেন, ওয়াকিটকির শব্দ আর ব্যস্ত পুলিশ স্টেশনের আবহ। রাহি কাঁদছে। একদম রাহির কণ্ঠ। মনে হলো- অনেক মার খেয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছে- পুলিশ ধরেছে। মাদক পেয়েছে। আমাকে ছাড়াও। শব্দ শুনে মনে হলো, ফোনটা কেড়ে নিলো। এখন কয়েকজনের কথা শোনা যাচ্ছে। ওয়াকিটকির শব্দ আসছে। একজন বলছে, কোন ধারায় মামলা দেবো? আলোচনা চলছে। মাদকের কঠিন মামলা হবে। হঠাৎ একজন ফোনটা নিলেন। ভরাট গলা। বললো- আমি এসআই শফিক। রাহিকে ধরেছি। ওর সঙ্গের দু’জনের শরীর থেকে ৩০০ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে। ওর কাছে পাওয়া যায়নি। মামলা হবে। রাহি হবে ৩ নম্বর আসামি। আমি বললাম, কোন থানায় আছে এখন? এবারও ওপাশ থেকে সাড়া নেই। তারা আলোচনা করছেন। ৭২ ধারায় মামলা দেন। এসপি স্যারের রুমে যান। স্যারকে জানান। আবার ওয়াকিটকির শব্দ। খানিক বাদে আর একজন ফোন নিলেন। সে জানালো রাহি এখন রাজশাহী ডিবিতে আছে। মামলা হচ্ছে। কোর্টে তোলা হবে।
রাহির বড় ভাই বলেন, আমার গলা শুকিয়ে গেছে। ফোনটা কেটে গেল। আমরা নির্বাক। আব্বু চিন্তাগ্রস্ত। আমার স্ত্রী জানতে চাইলে বলি, রাহির কাছে মাদক পাওয়া যায়নি তবে ছাড়াতে হলে টাকা দিতে হবে। বিকাশ বা নগদ নম্বরে টাকা পাঠাতে হবে। আমার স্ত্রী বলে, পুলিশকে চার্জ দিতে হবে মানে? চার্জ নাকি ঘুষ চায়। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমরা চেনা পরিচিতদের ফোন করা শুরু করি। এরপর কোনো উপায়ান্তর পাই না। আমার স্ত্রী বললো, রাহিকে ফোন দাও। আমি আর আব্বু বললাম, রাহির সঙ্গের দুজনেরই কথা হয়েছে এসআই এর ফোন থেকে। তবুও আরেকবার ফোন দিলাম। রাহির একটা নম্বর ব্যস্ত পাওয়া গেল। এবার আব্বুর ফোনে রাহির ফোন এসেছে। আমরা সবাই আরও তটস্থ হলাম। কিছু হলো নাকি। আব্বু কথা বলছে। বুঝলাম রাহি নিরাপদেই আছে। আব্বুর বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি ফোন নিলাম। ও নিশ্চিত করলো ও রুমে আছে। ‘এসআই শফিকে’র নম্বরে ফোন দিলাম। নম্বর বন্ধ। আবার ফোন দিলাম। এসআই পরিচয় দেয়া শফিকের নম্বর বন্ধ। রাহির কাছে ফোন এসেছিল ০১৪০২৫০৩৪০৮ নম্বর থেকে।
একই রকম আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল সুলতানা মাহির সঙ্গে। তিনি থাকেন রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায়। তারা দু’জনই চাকরিজীবী। ছুটির দিন শুক্রবার তার স্বামী সজীব বন্ধুদের সঙ্গে ইফতারের জন্য ধানমণ্ডি যায়। মাহিও যায় ইফতারে ভার্সিটির অ্যালামনাইদের একটি ফোরাম ইফতারে, লালমাটিয়ায়। একসঙ্গেই মোটরসাইকেলে আসে তারা। লালমাটিয়ায় মাহিকে নামিয়ে দিয়ে সজীব যায় ধানমণ্ডিতে। ইফতারের ঠিক আগ মুহূর্তে অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। মাহিকে বলা হয়, সজীব একটি বাচ্চাকে মোটরসাইকেল দিয়ে হিট করেছে। বাচ্চার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এখন বাঁচাতে চাইলে জরুরি ২০ হাজার টাকা পাঠালে ছেড়ে দেবে। এরপর সজীবের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। সজীব জানায়- বিকাশে যা আছে আপাতত দিয়ে দাও। আরও টাকার ব্যবস্থা করো। ওয়াকিটকির একটি শব্দ ধীর থেকে প্রবল হলো। কেটে গেল ফোন। মাহি বলেন, আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কোনো কিছু না ভেবেই বিকাশে টাকা রিচার্জ করতে যাচ্ছিলাম। তখন বিষয়টি বুঝতে পেরে এক বন্ধু সজীবকে ফোন দিতে বলে। ইফতারের আগে ব্যস্ততার কারণে হয়তো ফোন ধরছিল না। আমি তার এক বন্ধুকে ফোন দেই- জানতে পারি যা ফোনে বলা হয়েছিল সব ভুয়া। তিনি বলেন, আমার কাছে যা টাকা ছিল আমি সব দেয়ার জন্যই দোকানে যাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেছে যে, বিশ্বাস করতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, সজীবের সঙ্গে প্রায় ৩০ সেকেন্ড কথা হলো আমার। তাকেও ০১৪০২৫০৩৪০৮ এই নম্বর থেকেই ফোন দেয়া হয়েছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে এখন রোবোকল নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ০১৮৯৮৯১৬২০৩ নম্বরসহ আরও কয়েকটি নম্বর থেকে কল দিয়ে নানা ধরনের কথা বলা হচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রে কোনো কথাই বলা হচ্ছে না। যারা কল দিয়ে কথা বলেন না তারা চান যাকে কল দেয়া হয়েছে তিনি কথা বলেন। কথা বললেই সেটি রেকর্ড করে রাখবেন। পরে প্রযুক্তির কেরামতিতে কণ্ঠটি টোপ হিসেবে ব্যবহার করে তার পরিবারের সঙ্গে প্রতারণা করবেন। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া বিভিন্ন ধরনের পোস্ট থেকে জানা যায় অনেককেই ফোন দেয়া হয়েছে বিভিন্ন নম্বর থেকে। আবার কয়েকজনকে একই নম্বর থেকে ফোন দেয়া হয়েছে। রোবোকল ছাড়াও সরাসরি কল করেও প্রতারণা করা হচ্ছে। একেক পরিবারের একেক ধরনের সমস্যার কথা বলা হয়। যারা এই কাজ করছেন তারা বিষয়টি এমনভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করেন বিশ্বাস না করার উপায় থাকে না। কাউকে বলা হয়েছে চাকরির কথা, রং নম্বর, ড্রাইভিং লাইসেন্স আপডেট, অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা, বিপণিবিতানের অফার এসব উল্লেখযোগ্য।
সাইবার সংশ্লিষ্টসূত্রগুলো বলছে, এটি প্রতারণার নতুন এক কৌশল। আগে বিভিন্ন মানুষকে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে তার কণ্ঠ রেকর্ড করে রাখা হয়। প্রতারকরা ফোন দিয়ে অনেক সময় কথা বলে না। আবার অনেক সময় বিভিন্ন অজুহাতে কথা বলে। মূল উদ্দেশ্য হলো কণ্ঠ রেকর্ড করে রাখা। পরে সেই কণ্ঠ ব্যবহার করে তাদের পরিবারে ফোন দিয়ে বিভিন্ন বিপদে বা সমস্যায় পড়ার কথা বলা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে নিজের স্বজনের বিপদের কথা তার নিজের মুখে শুনে অনেকেই টাকা পাঠিয়ে দেন। আবার অনেকেই টাকা পাঠানোর আগে একটু কৌশলী হয়ে সত্যতা জানতে পারেন। টাকা নেয়ার পর প্রতারকরা মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখে। পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, মূলত এআই ব্যবহার করে এসব কাজ করছে কিছু চক্র। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক ছড়িয়ে দুর্বলতার জায়গায় আঘাত করে প্রতারণা করাই তাদের কাজ। এটি প্রতারকদের নতুন কৌশল। তবে যাদের কাছেই ফোন যাবে তারা সতর্ক থাকবে। যার কথা বলে ফোন দেয়া হবে তার নিজের নম্বরে ফোন দিয়ে কথা বলে নিশ্চিত হতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ কাউকে এভাবে কখনো কল করে না। এ ধরনের ফোনকল আসলেই ধরে নিতে হবে এরা প্রতারক। প্রতারণার উদ্দেশ্যে ফোন দিয়েছে। তাই ভুলেও প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটবে তখন নিকটস্থ থানায় অভিযোগ দিতে হবে। অভিযোগ দিলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।