
‘দুর্নীতি ও হয়রানির জন্যই যেন এনটিআরসিএ। হাজার হাজার শূন্যপদ রেখেও পদায়ন না করা, ভুয়া সনদ, গণবিজ্ঞপ্তি জারিতে কালক্ষেপণ, বদলির ব্যবস্থা না রাখা এসবই করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। চাকরিপ্রত্যাশীদের দিনের পর দিন করে যেতে হচ্ছে দাবি আদায়ের আন্দোলন। আদালত পাড়াতেও গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটি আয় করছে কোটি কোটি টাকা। ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না প্রতিষ্ঠানটির। চেয়ারম্যান আসে, চেয়ারম্যান যায়। কিন্তু বন্ধ হয় না হয়রানি। চাকরিপ্রত্যাশী বেকার কেউ নিবন্ধন পরীক্ষায় পাসের মধ্যদিয়েই যেন নাম লেখান ভোগান্তির খাতায়।’ এসব গুরুতর অভিযোগ উল্লেখ করে ‘পদে পদে অনিয়ম, হয়রানি এনটিআরসিএ-তে’ শিরোনামে ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রি. দৈনিক কালের কণ্ঠে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমন অসংখ্য অভিযোগ এনটিআরসিএ-এর বিরুদ্ধে।
২. গত ৪ জুন প্রকাশিত ১৮তম নিবন্ধনের ভাইভা ফলাফল-বঞ্চিত প্রার্থীদের অভিযোগ — অতীতের সকল দু্র্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অনিয়মের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবারের ভাইভা ফলাফল-বিতর্ক। কোনো ধরনের নিয়ম-নীতি ও নৈতিকতার ধার ধারেনি এনটিআরসিএ। ভাইভা বোর্ডের অনেক এক্সটার্নাল জানেন-ই না যে, ভাইভায় প্রাপ্ত নাম্বার মেধা তালিকায় যোগ হয় না। চাকরি পেতে সামান্য প্রভাবও ফেলে না। তারপরও ভাইভায় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও গেটআপের ৮ নাম্বারের মধ্যে মাত্র ৩.২ নাম্বার না পাওয়ার অযুহাতে যোগ্যদের ফেল করানো হয়েছে।
৩. বিশেষ করে আরবি প্রভাষকের ভাইভায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি অনিয়মের অভিযোগ। ড্রেস-আপ অপছন্দ হওয়া, আরবি বলার টোনে আঞ্চলিকতার প্রভাবের কারণেও ফেল করানো হয়েছে। এমনকি ঢাকার কয়েকটি কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ভাইভা প্রার্থীদের। কিছু কিছু ভাইভা বোর্ড ছিল অসৌজন্যমূলক আচরণ, যাচ্ছেতাই প্রশ্ন, এখতেলাফি মাসয়ালার বাড়াবাড়ি, বিতর্কিত রাজনৈতিক প্রশ্ন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ভাইভা প্রার্থীর ভূমিকাসহ নানা অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে দারুণ স্বেচ্ছাচারি। বোর্ড ভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৫ মে অনুষ্ঠিত আরবি প্রভাষক (কোড-৪২৯) পদের গ্রুপ-05A সকাল ৯.৩০ এর ভাইবা বোর্ডে ৩০ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ১ জন পাস করেছেন, ২৯ জনই ফেল করেছেন। আবার একই তারিখের গ্রুপ-01B এর সকাল ১১:৩০ এর বোর্ডে ৩০ জন প্রার্থীর ২৬ জন পাস করেছেন, ৪ জন ফেল করেছেন। গত ৮ মে অনুষ্ঠিত একই পদের গ্রুপ-03B সকাল ৯:৩০ এর ভাইবা বোর্ডের ৩০ জন ভাইবা প্রার্থীর মধ্যে পাস করেছেন ৫ জন, ২৫ জনই ফেল করেছেন। এমন ভাইভা বোর্ড ছিল ছয়-সাতটি।
৪. আরবি প্রভাষকে ভাইভা দেয়া প্রার্থী জুয়েল হোসাইন (ছদ্মনাম) ছারছীনা আলিয়া থেকে দাখিল ও আলিমে গোল্ডেন পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সিজিপিএ নিয়ে বের হয়েছেন। ভাইভা বোর্ডে তাকে সাতটি প্রশ্ন করা হয়েছে। সাতটি প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়েছেন। ভাইভা বোর্ড তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করেছে। কিন্তু ফলাফল আসেনি। তাকে ফেল করানো হয়েছে। একই প্রার্থী সহকারি মৌলভীতেও ভাইভা দিয়েছেন। অজুর ফরজ কয়টি জিজ্ঞেস করে তাকে বিদায় করা হয়েছে। ফলাফল একই। পাস করানো হয়নি। এই প্রার্থী দাবি করেছেন তিনি রিটেনে মিনিমাম ৮৫+ নম্বর পাবেন।
৫. কিছু বোর্ডে ভাইভা প্রার্থীদের প্রশ্ন করেছে, কী নাম? বাড়ি কোথায়? ওকে আসতে পারেন। কিছু বোর্ডে প্রশ্ন করেছে, নুরুল আনোয়ার কিতাব পড়েছেন? পড়লে বলেন তো, মূল কিতাবের ৩৩ পৃষ্ঠার প্রথম লাইনটা কী? এভাবে ১৭টি প্রশ্ন করেছে। কিছু বোর্ডে, আরে মা/বাবা, এসেছো এসেছো!! বলো তো, মা/বাবা, তোমার থানার নাম কী? কেউ কেউ শুধু নাম জানতে চেয়ে বিদায় করেছে। কারো ভাইভা ১৫ মিনিট হয়েছে। সকল প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়েছে। তারপরও ফেল! কিছুটা ওই গল্পের মতো। যাকে পছন্দ তাকে বলে, ‘তোমার কী নাম?’ যাকে অপছন্দ তাকে বলে, ‘বারাক ওবামার দাদার কী নাম?’ এই ছিল অবস্থা।
৬. বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রায় অর্ধশত প্রার্থীর সাথে কথা বলে জেনেছি, ভাইভায় প্রশ্নের ন্যূনতম স্টান্ডার্ট বজায় ছিল না। যেমন খুশি তেমন ভাইভা নিয়েছে এনটিআরসিএ। এই অভিযোগ শুধু অর্ধশত প্রার্থীর নয়, হাজার হাজার প্রার্থীর। রিটেনে অনেক ভালো করেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তিনি ফেল করতে পারেন না তা অবশ্যই নয়। কিন্তু তাকে ভাইভা বোর্ডে অপমান করা হবে কেন?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারুফ হাসান (ছদ্মনাম) বলেন, ‘এনটিআরসিএ-এর গোয়ার্তুমি, স্বেচ্ছাচারিতা, বেকারদের প্রতি জুলুম নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ন্যূনতম স্টান্ডার্ট মান বজায় রাখেনি কিছু কিছু বোর্ড। তারা অতীতের সকল অনিয়মের সীমা অতিক্রম করেছে এবার।’ ভাইভা বোর্ডে এক্সটার্নাল হিসেবে ছিলেন এমন কয়েকজন ব্যক্তিও ভাইভা বোর্ডের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা লিখেছেন, ‘নিজেদের অতিরিক্ত পাণ্ডিত্য দেখাতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। আমরা যেখানে মাদরাসায় ভালো শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারি না, সেখানে তারা ভালো ভাইভা প্রার্থীদের অযথা, অযৌক্তিক কারণে ফেল করাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে ভঙ্গুর মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আর টিকেও থাকবে না।’
৭. গত ১৫ জুন, রোববার সকাল থেকে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ১৮তম নিবন্ধনে ভাইভা ফলাফল-বঞ্চিত প্রার্থীরা এনটিআরসিএ’র কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরবর্তীতে একটি দল সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করে এসব অনিয়মের কথা তুলে ধরেন। পরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তিনি বলেন, ‘১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের মৌখিক পরীক্ষায় মূল ভূমিকা পালন করেছেন এক্সটার্নাল অর্থাৎ বাহির থেকে যারা পরীক্ষা নিতে এসেছিলেন তারা। প্রার্থীদের পাস, ফেল অনেকটা তারাই নির্ধারণ করেছেন। মৌখিক পরীক্ষা এবার তুলনামূলক কঠিন হওয়ায় ফেলের সংখ্যা কিছুটা বেশি।’
তার এ দাবির সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করেছেন ভাইয়া-বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। মূলত তিনি দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন। এক্সটার্নাল নিজেই জানেন না যে, ভাইভায় ফেল করানো অসাংবিধানিক, এনটিআরসিএ'র নিয়মবহির্ভূত। সার্কুলারে উল্লেখ ছিল পাসের জন্য লিখিত ও ভাইভায় মিনিমাম ৪০% শতাংশ নাম্বার পেতে হবে। ভাইভাতে ২০ নাম্বারের মধ্যে ১২ সার্টিফিকেট থেকে আর ৮ উপস্থিতি, পোশাক, ও জিজ্ঞাসাবাদ থেকে। উভয়টিতে আলাদাভাবে ৪০% পেয়ে পাস করতে হবে। কিন্তু ১৮তম ভাইভাতে এসব আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।
৮. এনটিআরসিএ’র কার্যালয়ের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী মোশরেকা জাহান (ছদ্মনাম) বলেন, ‘গত ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরেরা এখনো এখানে সক্রিয়। প্রহসনের ভাইভা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উস্কে দিয়েছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ আড়াই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ৪০ সেকেন্ডের ভাইভায় পণ্ড করে দিয়েছেন।’
পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে এবারের রিটেনের সিলেবাস পরিবর্তন করা হয়েছে। রিটেনে প্রশ্নের উত্তর দেয়োর ক্ষেত্রে কোনো অপশন রাখা হয়নি। তারপরও সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে, অন্যায়ভাবে, অসাংবিধানিকভাবে প্রায় ২১ হাজার প্রার্থীকে ফেল করানো হয়েছে। গত নিবন্ধনগুলোতে চূড়ান্ত ফলাফলে যেখানে ৯৭% থেকে ৯৯% পাস করানো হয়েছে; এবার কেন তা নামিয়ে ৭০-৭৫% করা হলো? এই প্রশ্ন আমার মতো ২১ হাজার শিক্ষার্থীর।’
লেখক,
কবি ও শিক্ষক