Image description

ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালত ভবনের (পুরনো) দোতলায় পরিবেশ আদালত। এজলাসের সামনে নথি (আদালতের ভাষায় ফাইল) উপচে পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চারদিক। ছোট এই এজলাসের চারদিকে আটটি স্টিলের আলমারি। ছাদ ছুঁইছুঁই দুটি বড় র‌্যাক। যা মামলার নথিতে ঠাসা। এজলাসের ডায়াসের সামনে এগিয়ে বিচারকের আসনে চোখ পড়লে দেখা যায়, বসার জায়গাটি ঢেকে গেছে মামলার নথিতে। আসনের সামনে, ডানে, বামে ও পেছনে বিচারাধীন মামলার নথির স্তূপ। একই অবস্থা ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে। ভবনের দোতলার পশ্চিম পাশের বাঁদিকে একটি শৌচাগার রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, মামলার এতই চাপ, কয়েক বছর ধরে এই শৌচাগারটিকেই রেকর্ডরুম বানাতে হয়েছে। আদালতসংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা বলেন, এমন অবস্থা অনেক আদালতে। অনেক সময় দৃষ্টিকটু দেখাবে বলে নথিগুলো কোনো মতে আড়াল করা হয়।

সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন বা অনিষ্পন্ন মামলা এখন ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০। একে তো লাখ লাখ মামলার চাপ। অন্যদিকে আদালত জুড়ে থাকা হাজার হাজার নথি সংরক্ষণে নেই সুরক্ষিত জায়গা। ফলে বাস্তবতা হলো, ব্যাপক হারে মামলা নিষ্পত্তি হলেও বিচারাধীন মামলা শুধুই বাড়ছে।

আইন ও বিচার-বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিচারকদের আন্তরিকতার পরও লাখ লাখ বিচারাধীন মামলার ঊর্ধ্বমুখিতার এটি অস্বাভাবিক চিত্র এবং তা বিচারপ্রত্যাশীর অবিরত আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক কষ্টের কারণ। ধুলোমাখা একেকটি নথি যেন ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থীর দীর্ঘশ্বাসেরই প্রতিচ্ছবি।

সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন বা অনিষ্পন্ন ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০ মামলার মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৭ লাখ ২১ হাজার ২৬৬। ফৌজদারি মামলা ২৫ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪৩ এবং অন্যান্য ১ লাখ ৩২ হাজার ৬০১টি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলা ৬ লাখ ৬ হাজার ১৮১। এর মধ্যে আপিল বিভাগে দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন ১৭ হাজার ৯৮৯টি। ফৌজদারি ১০ হাজার ৭১৫টি এবং কনটেম্পট (আদালত অবমাননা) ১৯৭ মামলাসহ বিচারাধীন ২৮ হাজার ৯০১টি। হাইকোর্টে দেওয়ানি ৯৭ হাজার ৪৭৫, ফৌজদারি ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৪০১ ও রিট মামলা ১ লাখ ৩২ হাজার ৪০৪-সহ বিচারাধীন ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৮০। অন্যদিকে অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ৩৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩২৯টি মামলা। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৬ লাখ ৫ হাজার ৮০২ এবং ২২ লাখ ৩১ হাজার ৫২৭ ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন।

গত ১ জানুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টা। ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত ভবনের চতুর্থতলায় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ কোর্ট-১-এর আদালতে যতদূর চোখ যায় মামলার নথি আর নথি। ১২টি স্টিলের আলমারি, চারটি বড় র‌্যাক নথিতে ভরপুর। আলমারির

ওপরে মামলার নথি। এমনকি আসামির হাজিরার কাঠগড়ায় নথিসমেত দুটি আলমারির পাশেই দেখা গেছে নথির স্তূপ।

আদালতের একজন কর্মচারী নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মামলা যত নিষ্পত্তি হয়, তার চেয়ে বেশি মামলা আসে আদালতে। একদিকে মামলার চাপ, অন্যদিকে নথি রাখার রেকর্ডরুম, স্টোররুম না থাকায় কোনো মতে নথি রাখতে হয়।’

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার আদালত এলাকায় দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য মামলার প্রায় দেড়শ আদালত রয়েছে। গত কয়েক দিনে দেশ রূপান্তরের এই প্রতিবেদক ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত ভবন, ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালত (নতুন ও পুরনো ভবন) ভবনসহ অন্তত ৪০টি আদালত ঘুরে আদালত-সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবগুলো আদালতে নথির স্তূপের একই চিত্র দেখা গেছে। প্রতিটি আদালতে ৪ থেকে ১২টি পর্যন্ত স্টিলের আলমারির সঙ্গে বড় বড় র‌্যাক ভরে গেছে নথিতে। আদালতের বিচারকের আসনের জায়গায়, মেঝেতে, পেশকারের বা কর্মচারীদের বসার স্থানের আশপাশে, সাক্ষীর সাক্ষ্য দেওয়ার ডকে, মামলার নথি রাখা হয়েছে কোনোমতে। অন্তত পাঁচটি আদালতে দেখা গেছে, আসামি হাজিরার কাঠগড়াতেও নথির স্তূপ। ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, মহানগর দায়রা আদালতের অধীন ২৪টি ফৌজদারি আদালতে এখন বিচারাধীন মামলা ১ লাখ ৬০ হাজার ৭২৪। তবে এত মামলার নথি রাখার মতো রেকর্ডরুম নেই।

আদালত-সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত ভবনটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে। ভবনের দোতলার পশ্চিম পাশের বাঁদিকে একটি শৌচাগার রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, মামলার এতই চাপ যে, কয়েক বছর ধরে এই শৌচাগারটিকেই রেকর্ডরুম বানিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে এই কক্ষে দেখা গেছে, স্যাঁতসেঁতে কক্ষে শৌচাগারের একপাশে একাধিক র‌্যাক ভরে গেছে নথিতে। এখন রাখতে হচ্ছে মেঝেতে। আদালত-সংশ্লিষ্টরা জানান, পাঁচ হাজারের বেশি মামলার নথি আছে এই কক্ষে।

ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবু হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তি যত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মামলা আসছে। কিন্তু নথি রাখার মতো রেকর্ডরুম বা জায়গা নেই। অপরাগ হয়ে এভাবেই রাখতে হয়।’

ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেসব মামলা ডিসমিসড ফর ডিফল্ট (তদবিরের অভাবে খারিজ) হয়, সেগুলো নির্দিষ্ট সময়ে আদালতের অনুমতি নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এ সংখ্যা বেশি নয়। মামলায় তদবির বা চলমান থাকলে নথি সংরক্ষণ করতে হয়।’

বিচারাধীন মামলা বা নথির স্তূপ কেন বাড়ে এমন প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আদালত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, আদালতের ওপর আস্থা ও নির্ভরতা, অধস্তন ও উচ্চ আদালতে একটির পর একটি আইনি ধাপ, মামলা করার প্রবণতা বাড়াসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুয়া অভিযোগে মামলা, ঘন ঘন শুনানি মুলতবি, সাক্ষীর গরহাজিরা, বিচারক ও অবকাঠামো সংকটসহ মামলাজট নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট মহাপরিকল্পনা না থাকাই আপাতদৃষ্টিতে মামলার জট বাড়ার কারণ।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিটি নথির মধ্যে বিচারপ্রার্থীর বিচারের প্রত্যাশা থাকে। চূড়ান্ত বিচার হলে তো আর কোনো প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। বিচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নথিগুলো রাখতে হয়। কিন্তু সেই চূড়ান্ত পর্যায় অনেকে দেখতে পারেন না। আর এত নথি মানে মামলার জট অনিয়ন্ত্রিত। এর সঙ্গে বিচারপ্রত্যাশীদের কষ্ট ও হতাশাও বাড়ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মামলার কারণ কিন্তু রাষ্ট্রই তৈরি করছে। রাষ্ট্রের যা পরিস্থিতি, এখন বিচার বিভাগেরও একই পরিস্থিতি। বিচারে স্থবিরতা, বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা এগুলো একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে। এ থেকে উত্তরণে যদি মহাপরিকল্পনা নেওয়া না হয়, তাহলে বিচার বিভাগ নিয়ে মানুষের মনে যে অনাস্থা, তা দিন দিন বাড়তেই থাকবে।’ 

হাইকোর্টেও বাড়ছে মামলার স্তূপ : হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবন, মূল ভবনসহ অন্তত ১৫টি আদালত (বেঞ্চ) ঘুরে দেখা গেছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অনেক আদালতের এজলাস ও তার আশপাশে মামলার নথিতে ভরে গেছে। একেকটি বেঞ্চে দুই থেকে পাঁচটি বা তার বেশি স্টিলের আলমারি বা র‌্যাক রয়েছে নথি সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু মামলার চাপে নথি রাখতে হয় বেঞ্চ কর্মকর্তাদের টেবিলের ওপর ও নিচে। কখনো কখনো বিচারপতিরা যেখানে বসেন, তার আশপাশেও।

আদালত-সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা বলেন, বেঞ্চগুলোর নিজস্ব কোনো রেকর্ডরুম নেই। আইনজীবীদের মেনশন সিøপের পর সংশ্লিষ্ট শাখা বা রেকর্ডরুম থেকে মামলার নথি আনতে হয়। মামলার চাপে রেকর্ডরুমেও এখন জায়গার সংকুলান।

অ্যানেক্স ভবনের দোতলার একটি দেওয়ানি বেঞ্চে দেখা গেছে, বেঞ্চ কর্মকর্তাদের বসার চারদিকে নথির স্তূপ। এমনকি বিচারপতিরা এজলাসের যেখানে বসেন, সেখানেও রাখা হয়েছে নথি। সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, মামলার এত চাপ যে নিষ্পত্তির আগেই পরবর্তী মামলার নথি প্রস্তুত রাখতে হয়। একই ভবনের ফৌজদারি মামলার শুনানি হয় এমন একটি বেঞ্চ ঘুরে দেখা গেছে প্রায় একই চিত্র।

বেঞ্চ কর্মচারীরা বলেন, বিচারপতিদের আসনে নথি রাখা বিব্রতকর হলেও বাধ্য হয়েই কাজটি করতে হচ্ছে। অ্যানেক্স ভবনের চতুর্থতলায় রেকর্ডরুম বলে পরিচিতি বিশাল দুটি কক্ষ ঘুরে দেখা গেছে, হাজার হাজার মামলার নথি। এমনকি বারান্দার দুপাশে বৃষ্টি আর ধুলো থেকে রক্ষা করতে ত্রিপল দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। 

সার্বিক বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনিক আর হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিচার বিভাগের জন্য যে লোকবল, তা নেহাতই অপ্রতুল। আর মামলা নিষ্পত্তির আগেই অন্তর্বর্তী আদেশের বিষয়ে পক্ষগণকে হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ বা অন্যান্য আদালতে যেতে হয়। কিন্তু মূল মামলা থেকেই যায়।

তিনি আরও বলেন, আইনজীবীদের মধ্যেও একটা নেতিবাচক দিক আছে যে মামলা ফাইল করে বারবার শুনানির জন্য তারিখ নেয়। এ কারণেও মামলা কিন্তু চলতেই থাকে। চাপটা পড়ে বিচারক ও বিচারপ্রত্যাশীদের ওপর। এই যে জমা হয়, এটাই কিন্তু একটা পর্যায়ে এ রকম খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করছে। শুনানির ঘন ঘন মুলতবি রুখতে একটা জরিমানার আওতায় আনা হলে, এ প্রবণতা কমে যাবে।

ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, ‘এ বিষয়গুলো যতক্ষণ না চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’