
চলতি বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিনেই সারাদেশে অনুপস্থিত ছিল প্রায় ২৭ হাজার, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৭ হাজার বেশি। শুধু ঢাকা বোর্ডে অনুপস্থিত ছিল তিন হাজার ৪৯৬ জন। ইংরেজি পরীক্ষার দিনে সেই উপস্থিতি আরও কিছু বেড়ে প্রায় চার হাজারে ঠেকে। আর সব পরীক্ষা মিলিয়ে ঢাকা বোর্ডে অনুপস্থিত ছিল প্রায় সাড়ে ছয় হাজার।
বিষয়টি আমলে নিয়ে অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে নামে ঢাকা বোর্ড। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণ জানাতে বলা হয়। মাঠপর্যায়ের সেই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসএসসি পরীক্ষায় অনুপস্থিতির সবচেয়ে বড় কারণ পরীক্ষার আগে বিয়ে হওয়া।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, মেয়েদের ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছরের নিচে বিয়ে হলে সেটিকে বাল্যবিয়ে বলা হয়। অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশনের সময় যে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয়, তাতে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর বয়স অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে হয়।
বাল্যবিয়ের পেছনে অসচ্ছলতাও বড় কারণ। অভিভাবকরা মেয়েদের জন্য খরচ করার চেয়ে ছেলে সন্তানের পেছনে খরচ করাকে বেশি প্রাধান্য দেন। নিরাপত্তাহীনতাও মেয়েদের বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ। এজন্য সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।-গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী
ঢাকা বোর্ড বলছে, পরীক্ষায় অনুপস্থিত প্রতি ১০০ জনের ৪০ জনই বাল্যবিয়ের শিকার। তাদের মধ্যে অনেকে গর্ভধারণও করেছেন। অধিকাংশই জানিয়েছেন, তাদের আর পড়ালেখায় ফেরা হবে না। ফলে ফরম পূরণ করেও এসএসসির আগেই শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়েছেন তারা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। শুধু হঠাৎ বাড়িতে গিয়ে বিয়ে ঠেকালে হবে না। দীর্ঘমেয়াদে বাল্যবিয়ে রুখতে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
এবার এসএসসিতে অনুপস্থিতি যেমন ছিল
১১টি শিক্ষা বোর্ডের মোর্চা বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি সূত্র জানায়, গত ১০ এপ্রিল এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়। এতে অংশ নিতে ফরম পূরণ করেন ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৮১ জন শিক্ষার্থী, যা ২০২৪ সালের চেয়ে প্রায় এক লাখ কম। শুধু তাই নয়, বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
এদিকে, প্রথম দিনে এসএসসির বাংলা প্রথমপত্র, দাখিলে কোরআন মাজিদ ও তাজভিদ এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালে বাংলা-২ বিষয়ের পরীক্ষা হয়। সেদিন ২৬ হাজার ৯২৮ জন (ঢাকা বোর্ডের ৩৪৯৬ জন) পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। অথচ গত বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় প্রথম দিনে অনুপস্থিত ছিল ১৯ হাজার ৩৫৯ পরীক্ষার্থী।
বাল্যবিয়েকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে বহু আগেই চিহ্নিত করে তা নিয়ে সচেতনতামূলক অনেক কাজ হয়েছে। এরপরও লেজেগোবরে অবস্থা। এক্ষেত্রে শুধু খবর পেয়ে বাড়ি গিয়ে একটা বিয়ে বন্ধ করে মিডিয়া কাভারেজ নিলে হবে না, টেকসই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সেটা করতে হলে অবশ্যই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি।-ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান
পরীক্ষার দ্বিতীয় দিনে গত ১৫ এপ্রিল এসএসসির ইংরেজি প্রথমপত্র, দাখিলের আরবি দ্বিতীয়পত্র এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের গণিত-২ বিষয়ের পরীক্ষায় মোট অনুপস্থিত ছিলেন ২৮ হাজার ৯৪৩ জন। ১৭ এপ্রিল তৃতীয় দিনে এসএসসির ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র, দাখিলের গণিত এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের আরবি-২ বিষয়ের পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন ২৭ হাজার ৯০৫ জন।
পরীক্ষার শেষ দিন ১৩ মে এসএসসির বাংলা দ্বিতীয়পত্র, দাখিলের আরবি প্রথমপত্র এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ইংরেজি-২ বিষয়ের পরীক্ষায় মোট ৩১ হাজার ১০৫ জন অনুপস্থিত ছিলেন। এদিন বাংলা দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষায় অংশ নেননি ঢাকা বোর্ডের চার হাজার ১৬৪ জন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার জানান, ঢাকা বোর্ডের অধীনে থাকা সবগুলো জেলার কেন্দ্র মিলিয়ে এবার ছয় হাজার ৩৮৯ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে এক হাজার ২০৩ জন পরীক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণসহ তথ্য পেয়েছে বোর্ড।
তার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এসব পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা দেয়নি। কী কারণে তারা পরীক্ষা দিতে পারেনি, তা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করে শিগগির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলেও জানান অধ্যাপক কামাল উদ্দিন হায়দার।
অনুপস্থিতি বেশি গ্রামে ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী—অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদেরর মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থী ৭০ শতাংশ এবং অনিয়মিত ৩০ শতাংশ। মোট অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৬০ শতাংশই ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের। বাকি ২৩ শতাংশ মানবিক ও ১৭ শতাংশ বিজ্ঞান বিভাগের। মফস্বল বা একেবারে গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বেশি। ৭৬ শতাংশের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষার্থী গ্রামের। বাকি ২৪ শতাংশ শহর এলাকার।
পরীক্ষায় অনুপস্থিতির যত কারণ
ঢাকা বোর্ডের প্রতিবেদনে অনুপস্থিতির কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিয়ের কারণে আর পরীক্ষায় বসতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীদের বাল্যবিয়ে হয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে কিছু ছেলে শিক্ষার্থীও বিয়ে করেছে। সে কারণে তারা পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। তবে ছেলে ও মেয়েদের সংখ্যা আলাদাভাবে কত, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেন বোর্ড।
বাল্যবিয়ে কমেছে বলে আমাদের একটা ধারণা ছিল। হয়তো কমেছে...কিন্তু যে তথ্য সামনে আসছে সেটা তো উদ্বেগজনক। আমাদের নতুন করে ভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এগোতে হবে। এটা শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের
শুধু বাল্যবিয়ে নয়, বিয়ের পর গর্ভধারণের কারণেও অনুপস্থিতির তথ্য উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। ঢাকা বোর্ড এমন ২১ জন ছাত্রীর তথ্য পেয়েছে, যারা বিয়ের পর গর্ভধারণ করায় পরীক্ষা দিতে পারেনি। এটি মোট অনুপস্থিতির প্রায় ২ শতাংশ।
অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিত ছিল ২৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী। প্রস্তুতি ভালো না থাকায় পরীক্ষা দেয়নি ১১ শতাংশ, পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে কর্মমুখী হয়ে পড়ালেখা বাদ দেওয়ায় অনুপস্থিতির হার ৭ শতাংশ। তাছাড়া অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানাভাবে মারা গেছে ১৭ জন। বাকিরা পরিবারের কারও অসুস্থতা, মৃত্যুসহ বিভিন্ন কারণে অনুপস্থিত ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর পড়ালেখায় ফিরবে না ৫১ শতাংশ
ঢাকা বোর্ড যেসব অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের কারণ অনুসন্ধান করতে পেরেছে, তাদের মধ্যে ৫১ শতাংশের বেশি পরীক্ষার্থী জানিয়েছে, তারা আগামীতে আর পড়ালেখায় ফিরবে না। কেউ সংসার, কেউ কাজে মনোযোগী হবে। বাকি ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তারা আগামী বছর পুনরায় ফরম পূরণ করে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ রয়েছে।
তবে তাদের অনেকে আর্থিকভাবে অসচ্ছল। ফলে আগ্রহ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা টিকে থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভিন্ন উদ্যোগ নেবে সরকার
বাল্যবিয়ের সঙ্গে আর্থিক অসচ্ছলতা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে মনে করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাল্যবিয়ের পেছনে অসচ্ছলতাও বড় কারণ। অভিভাবকরা মেয়েদের জন্য খরচ করার চেয়ে ছেলে সন্তানের পেছনে খরচ করাকে বেশি প্রাধান্য দেন। নিরাপত্তাহীনতাও মেয়েদের বাল্যবিয়ে অন্যতম কারণ। এজন্য সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।’
শুধু সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমানও। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাল্যবিয়েকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে বহু আগেই চিহ্নিত করে তা নিয়ে সচেতনতামূলক অনেক কাজ হয়েছে। এরপরও লেজেগোবরে অবস্থা। এক্ষেত্রে শুধু খবর পেয়ে বাড়ি গিয়ে একটা বিয়ে বন্ধ করে মিডিয়া কাভারেজ নিলে হবে না, টেকসই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সেটা করতে হলে অবশ্যই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি।’
বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সরকারি-বেসরকারিভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ হচ্ছে। তারপরও এমন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাল্যবিয়ে কমেছে বলে আমাদের একটা ধারণা ছিল। হয়তো কমেছে...কিন্তু যে তথ্য সামনে আসছে সেটা তো উদ্বেগজনক। আমাদের নতুন করে ভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এগোতে হবে। এটা শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেলে শিক্ষা উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করবো।’