Image description
তদন্ত করছে দুদক

শিক্ষা প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের জন্য সম্প্রতি ‘এক কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব’ পেয়েছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার, যিনি সি আর আবরার নামে পরিচিত। গত ৪ জুন সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেই এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করে বলেন, তিনি ওই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার এই বক্তব্যের পর শিক্ষা প্রশাসনে শুরু হয় হৈচৈ। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কে সেই ব্যক্তি যিনি এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে একটি পদে বসতে চান, আর দপ্তরই বা কোনটি। যদিও উপদেষ্টা এখনো দপ্তর ও ওই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেননি।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে দপ্তরটির নাম জানতে পেরেছে কালবেলা। দপ্তরটি হলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং এর চেয়ারম্যানের শূন্য পদের জন্য কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ওই পদের জন্য বিপুল টাকা ঘুষের প্রস্তাব কে দিয়েছিল, তা জানতে গিয়ে দুজনের নাম পাওয়া যায়। তারা দুজনই ১৪তম বিসিএসের শিক্ষা কর্মকর্তা। একজন এনসিটিবিতে কর্মরত, অন্যজন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক। প্রথম ব্যক্তিটি এনসিটিবির গুরুত্বপূর্ণ পদে (সদস্য) রয়েছেন। বিগত সরকারের সময় তিনি একটি শিক্ষা বোর্ডে ছিলেন। তার বাড়ি নোয়াখালী অঞ্চলে। তাদের দুজনের মধ্যে কে ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা সুনির্দিষ্ট করে জানা সম্ভব না হলেও অধিদপ্তরের পরিচালক এই ঘুষের প্রস্তাব করেছিলেন বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। আর প্রথমজন গত বছর বিনামূল্যের বই ছাপার কাগজ কেনাকাটায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিতর্কিত নেতা সালাউদ্দিন তানভীরের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন—এমন অভিযোগ রয়েছে। তাকে দপ্তর থেকে সরিয়ে দিতে স্মারকলিপি দিয়েছে ছাত্রদলসহ বিভিন্ন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ব্যাপারে তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে কল, এসএমএস এবং হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। তার একান্ত সচিব তাজকির-উজ-জামানের মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েও বক্তব্য জানতে পারেনি কালবেলা।

কালবেলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ মিলিয়ে মোট ২৯টি অধিদপ্তর, দপ্তর, কমিশন ও শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে রয়েছে ৯টি শিক্ষা বোর্ড, ২টি কমিশন এবং বাকিগুলো অধিদপ্তর। অন্যদিকে, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে রয়েছে ২টি শিক্ষা বোর্ড ও ৪টি অধিদপ্তর। দুই বিভাগের ডজনখানেক প্রকল্পও চলমান রয়েছে। এসব দপ্তরের মধ্যে গত বছর ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্যাপক রদবদল হয়। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পর্যায়েও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দপ্তর ও বোর্ডে নিয়োগ বা পদায়নের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক (অর্থ) পদে বিগত সরকারের একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে পদায়নের অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, শিক্ষায় ২৯টি দপ্তরের মধ্যে এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে আসার মতো দপ্তরের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদ। এর মধ্যে শুধু বর্তমানে এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদটিই শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিবের পদ দুটিও বর্তমানে শূন্য। তবে এ তিনটি শূন্য পদের মধ্যে এনসিটিবি চেয়ারম্যানের পদটিই সবচেয়ে ‘চাহিদাসম্পন্ন’, যেখানে এক কোটি টাকা দিয়ে আসার মতো লোক রয়েছে বলে মনে করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এনসিটিবি প্রতি বছর ৩২ থেকে ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্ব পালন করে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য সরকার বছরে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করে। অভিযোগ রয়েছে, এই বিপুল অংকের বই ছাপার দরপত্র এবং কাগজ কেনার প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ থাকে। যে কারণে এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদটি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছে আকর্ষণীয় ও লোভনীয়।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবির চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। নিয়মিত চেয়ারম্যান না থাকায় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তা আমি পালন করছি।’ এ পদের জন্য এক কোটি টাকা ঘুষ দিতে চায় এমন ব্যক্তিও আছে—প্রশ্ন রাখেন তিনি।

শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্যে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে, তবে যিনি বা যারা ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আরও বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিরা সচরাচর এ ধরনের স্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশ্যে দেন না। কারণ ঘুষ দেওয়া এবং নেওয়ার প্রস্তাব—দুটোই সমান অপরাধ। যেহেতু উপদেষ্টা পদাধিকার বলে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, সেহেতু তিনি তা করতে পারতেন বিভিন্নভাবে।’ অবশ্য ইফতেখারুজ্জামান এটিকে একটি ইতিবাচক দিক হিসেবেও দেখছেন। তার মতে, এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে শিক্ষা উপদেষ্টা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, ঘুষ নেওয়া কোনোভাবেই সহ্য করবেন না।

শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা ‘বদলি সিন্ডিকেট’ বা ‘বদলি বাণিজ্যে’র বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্যের মাধ্যমে আবারও প্রকাশ্যে এলো বলে মন্তব্য করেছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার। তিনি তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর আমরা ভেবেছিলাম ঘুষের প্রস্তাবকারীকে বরখাস্ত বা গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় উপদেষ্টারা পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারাবেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘শিক্ষা উপদেষ্টা এর মাধ্যমে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন, তার সময়ে কোনো ধরনের অনিয়ম বা বাণিজ্য চলবে না এবং যোগ্যতাই হবে পদায়নের মূল মাপকাঠি। অতীতে যা হয়ে থাকুক, এখন বদলি বাণিজ্য চলবে না। টাকা দিলেই বদলি বা নিয়োগ হবে না, যোগ্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

তবে শিক্ষা উপদেষ্টা চাইলে ঘুষের প্রস্তাবকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘সবকিছু প্রকাশ্যে আনাই একমাত্র উপায় নয়। চাইলে তিনি (শিক্ষা উপদেষ্টা) ব্যক্তিগতভাবে ডেকে সতর্ক করেও বিষয়টি সামাল দিতে পারতেন।’

সেদিন যা বলেছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা: আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে গত ৪ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় শিক্ষা ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে জিরো টলারেন্স নীতিতে অবস্থানের কথা উল্লেখ করেন শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার। একই সঙ্গে তিনি জানান, ব্যক্তিগতভাবে তাকে একটি বদলির জন্য এক কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘এখানে একটা উদাহরণ বলি। কোনো একটা কেসের ক্ষেত্রে আমার কাছে তদবির এসেছিল যে, একজনকে একটা বড় পোস্টিং দেওয়ার জন্য। তার জন্য প্রথিতযশা একজন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল (বুদ্ধিজীবী) তিনিও আমাকে (তদবির) করেছিলেন। যেহেতু সেই নিয়োগ যুক্তিযুক্ত হবে না, মানে যিনি পদ চাচ্ছিলেন সেই পদে তাকে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, তার ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়। আমরা সেটা প্রত্যাখ্যান করি। তখন তিনি অন্য পথে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন যে তারা এত টাকা...করবেন। অঙ্কটাও বলে দিই, এক কোটি টাকা তারা বলেছিলেন। যাকে বলেছিলেন, তিনি আমারই পরিচিতজন, যিনি একটি প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন। তিনি বলেছিলেন যে, ওই একটা ক্ষেত্রে আমি বলতেও পারব না, আর বলতে পারলেও প্রস্তাবে রাজি হবেন না।’