Image description

বর্ষা মৌসুমে রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতা যেন নিয়মিত চিত্রে পরিণত হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যায় অলিগলি থেকে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকটের মূলে রয়েছে অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল দখল করে ভরাট, রাস্তার প্রতিবন্ধকতা ও নাগরিক অসচেতনতা। সিটি করপোরেশন খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নিলেও পানি সরে যেতে বাধা দিচ্ছে বন্ধ হয়ে থাকা ড্রেন ও অকার্যকর স্লুইস গেটগুলো।

ফলে বছর বছর বর্ষা এলেই নাগরিকদের একই ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকালে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টিতে রাজধানীর রাজারবাগ, সূত্রাপুর, বংশালসহ বেশ কিছু এলাকায় পানি জমে যায়। তাতে ভোগান্তিতে পড়ে বাসিন্দারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ড্রেন না থাকা এবং বিদ্যমান ড্রেনগুলো অপরিষ্কার থাকায় অলিগলির পানি সরে যেতে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থার পেছনে দায়ী অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা, খাল দখল করে ভরাট, সড়কে বাধা এবং নাগরিক অসচেতনতা। ফলে রাজধানীতে যত ড্রেন-নালা আছে, তা থেকেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।

ভূমিরূপেই সমস্যা, প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে পরিকল্পনা

নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার প্রাকৃতিক ঢাল পূর্ব-পশ্চিমমুখী। পূর্বে বালু, পশ্চিমে তুরাগ নদ।

খালগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহও এই দুই দিকে। অথচ রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো তৈরি হয়েছে উত্তর-দক্ষিণমুখী, অনেক ক্ষেত্রে খালের ওপর দিয়েই। তাতে সড়ক হয়ে উঠেছে পানি আটকানো ‘বেড়িবাঁধ’। ড্রেনগুলোও অনেক সময় এই প্রবাহের বিরুদ্ধে নির্মিত, ফলে পানি নামার পথ আটকে যাচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের সব অবকাঠামো প্রকৃতিবিরোধী।
 
প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ উপেক্ষা করে সড়ক ও ড্রেন বানানোয় স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এই পরিকল্পনা-ভুলের খেসারত দিচ্ছে নগরবাসী।’

যতটুকু ড্রেন, তার অর্ধেকই অকার্যকর

ঢাকায় প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকেরও কম নালা-নর্দমা রয়েছে। এর বড় একটি অংশই ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ হয়ে আছে। রাস্তার পাশের ক্যাচপিটগুলো প্লাস্টিক, পলিথিন, নির্মাণসামগ্রী, বালু, কংক্রিটে ভরে ড্রেনের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ জানায়, নিয়মিত পরিষ্কারের পরও নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে এই চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়ছে।

জানা গেছে, মে মাসের শেষ দিকে হঠাৎ বৃষ্টিতে রাজধানীর লালবাগ, নিমতলী, বংশালসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে ছিল তিন-চার দিন। উত্তরের বিভিন্ন এলাকাও জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। দুটি সিটি করপোরেশন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে ‘জরুরি সাড়াদানকারী দল’ মোতায়েন করে পানি সরানোর কাজ করে।

স্লুইস গেট কার্যকর, কিন্তু...

দক্ষিণে ৫৫টি স্লুইস গেট রয়েছে, যার মধ্যে ৩৭টি বেড়িবাঁধঘেঁষা এবং ১৮টি কামরাঙ্গীর চরে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব গেট সচল থাকলেও অতিবৃষ্টির সময় নদীর পানি বেড়ে গেলে নগরীর পানি নদীতে যেতে পারে না। তখন জলাবদ্ধতা দীর্ঘায়িত হয়।

উত্তর সিটি করপোরেশন বর্ষার আগেই ১০০ কিলোমিটার এলাকায় আবদুল্লাপুর, বাউনিয়া, কল্যাণপুর, মহাখালীসহ ২৯টি খাল দখলমুক্ত করে পরিষ্কার করেছে। তবু জলাবদ্ধতার চিত্র খুব একটা বদলায়নি।

অভিযোগের ভিত্তিতে ধানমণ্ডি ২৭, আশকোনা, বনশ্রী, বেগুন টিলা, পশ্চিম কাজীপাড়া, কাঁঠালবাগান, মগবাজার ডাক্তার গলি, যমুনা ফিউচার পার্ক, প্যারিস রোড, কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশন, কাওলা, খিলক্ষেত বটতলা, কাজীপাড়া বসুন্ধরা লেন, আগারগাঁও ৬০ ফিট ভাঙা ব্রিজ, মিরপুর ১৪, পশ্চিম শেওড়াপাড়া মেট্রো রেল পিলার নম্বর ৩৬০, রূপনগর রোড নম্বর ৩৩ থেকে ৩৯, ইব্রাহিমপুর বাজার, উত্তরা সেক্টর ৩ রোড নম্বর ১৮, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এবং পল্লবী বেগুন টিলা, ভাটারা মেইন রোড, ফাসেরটেক সড়ক, ওয়াজউদ্দিন রোড, সরকারবাড়ি মোড় এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন করা হয়। 

বৃষ্টিতে রাজারবাগে হাঁটুপানি, স্থবির জনজীবন

রাজধানীতে গতকাল সকাল থেকে থেমে থেমে হওয়া মাঝারি বৃষ্টিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এলাকা ও আশপাশে জলাবদ্ধতা হয়। বিশেষ করে অলিগলি ও নিচু সড়কগুলোতে পানি জমে জনদুর্ভোগ বাড়ায়।

দেখা যায়, মালিবাগের দিক থেকে আসতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পাশের সড়কে হাঁটুপানি জমে আছে। অফিসগামী মানুষ ও পথচারীদের অনেকেই জুতা হাতে নিয়ে পানি ভেঙে হেঁটে যাচ্ছে। রিকশাগুলো স্বাভাবিক চলাচল করতে পারছে না।

স্থানীয় দোকানি শরীফ মিয়া বলেন, ‘এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যায়। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক না থাকায় সমস্যা বাড়ে। প্রতিদিন এমন হলে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ে।’

রাজারবাগে কর্মরত পুলিশ সদস্য আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টি থেমে গেলেও পানি নামতে অনেক সময় লাগে। অনেক সময় ইউনিফর্ম ভিজে যায়। রাস্তার এই অবস্থার কারণে সাধারণ মানুষও ভোগান্তিতে পড়ে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ১০৮ কিলোমিটার খাল পরিষ্কার করেছি, জরুরি অবস্থায় পানি বের হওয়ার পথ সচল করেছি। ৫৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের পরও আমরা দেখেছি প্রধান সড়কে এবার পানি জমেনি। এটি সম্ভব হয়েছে অল্প খরচে, পরিকল্পনার মাধ্যমে। তবে পরবর্তী সময়ে যারা দায়িত্বে আসবে, তারা যদি এই ধারা অব্যাহত রাখে, তবে ঢাকাকে বদলানো সম্ভব।’