অবৈধ উপায়ে অর্জিত ৫শ’ কোটি টাকা বৈধ করেন আলোচিত এস.আলম. গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের দুই পুত্র আসাদুল আলম মাহির এবং আশরাফুল আলম। এনবিআর’র রাজস্ব কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ২০২১ সালে তারা এ অর্থ বৈধ করেন। এর ফলে সরকার অন্ততঃ ৭৫ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়। এ তথ্য উঠে এসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কালো টাকা সাদাকরণের সহযোগিতাকারী তিন রাজস্ব কর্মকর্তাকে গত ১৭ অক্টোবর বরখাস্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের। সূত্রটি জানায়, হাসিনার দীর্ঘ ফ্যাসিজমের ‘গৌরিসেন’খ্যাত এস.আলম শিল্প পরিবার। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের মাফিয়া বলা হয় এস. আলম গ্রুপকে। হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করে একের পর এক লুন্ঠন করে এক ডজনের মতো প্রাইভেট ব্যাংক। নামে বেনামে ব্যাংক থেকে ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেয়।
শুধু হাসিনা ঘনিষ্ঠতার কারণে আ’লীগ সরকার তাদের ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে রাখে। এ সুযোগে শিল্প পরিবারটির প্রতিটি সদস্য পরিণত হয় মাফিয়াচক্রের সদস্য হিসেবে। এর ক্ষুদ্রতম দৃষ্টান্ত এস.আলম (সাইফুল আলম)র পুত্র আসাদুল আলম মাহির এবং আশরাফুল আলম।
সূত্রমতে, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত পদ্ধতিতে অর্জিত অবৈধ সম্পদ ‘বৈধ’ করতে ভুয়া পে-অর্ডার দিয়েছিলেন সাইফুল আলমের (এস.আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান) পুত্র আসাদুল আলম মাহির ও আশরাফুল আলম। অবৈধ উপায়ে অর্জিত ৫শ’ কোটি টাকা ‘বৈধ’ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের দুর্নীতিবাজ কর কর্মকর্তারা। এ পদ্ধতিতে তিনি সরকারের অর্থ আত্মসাত (কর ফাঁকি) করেন ৭৫ কোটি টাকা।
এনবিআর’র করা তদন্ত প্রতিবেদেনের তথ্য অনুযায়ী, এনবিআর’র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কর কর্মকর্তা এবং মাহির ও আশরাফকে দেয়া নোটিশ অনুসারে, কর ফাঁকি দিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ব্যাংকের দুটি ‘পে- অর্ডারের’ মাধ্যমে দুর্নীতির আশ্রয় নেন। এই ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণ করে সাইফুল আলমের মালিকানাধীন এস.আলম গ্রুপ।
প্রাপ্ত নথি বলছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ২৫ কোটি টাকার ২টি পে অর্ডারের মাধ্যমে এই কালোটাকা সাদা করার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হন মাহির ও আশরাফ। কয়েক মাস পর দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় পেমেন্টে সফল হন তারা। যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, দুটি পে-অর্ডারই ভুয়া।
তাদের ‘অবৈধ’ অর্থ ‘বৈধ’ করার এই বিশেষ সুযোগটি করে দেন এনবিআর কর্মকর্তারা। টাকা সাদা করার সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এস.আলম গ্রুপের মালিকের দুই পুত্রকে এ সুবিধা দেয়া হয়।
এনবিআর সূত্র জানায়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট ২ হাজার ৩১১ জন কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেন। তারা নগদ এবং ব্যাংক আমানতে ১ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা ‘বৈধ’ করেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ করের হার বিবেচনায় নিলে মাহির ও আশরাফুলকে ৫০০ কোটি কালো টাকার বিপরীতে কমপক্ষে ১২৫ কোটি টাকা কর দিতে হতো। অথচ তারা মাত্র ৫০ কোটি টাকার বিনিময়ে কালো টাকা সাদা করেন। তাদের ট্যাক্স রিটার্ন অনুসারে, মাহির ও আশরাফুল ২০২১ অর্থবছরে নিট সম্পদ দেখান যথাক্রমে ২৫০ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং ২৫০ কোটি ২১ লাখ টাকা।
মাহির তার টিআইএন সার্টিফিকেটে পরিচয় দেন ‘বিদেশী (অ-বাংলাদেশী)’ হিসেবে। আশরাফুল পরিচয় দেন ‘জাতীয় পরিচয়পত্রবিহীন বাংলাদেশী নাগরিক’ হিসেবে। এস.আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তাদের তিন পুত্র আহসানুল আলম, আশরাফুল এবং আসাদুল আলম মাহির ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। একইদিন তারা বিদেশী নাগরিক হিসেবে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পায় পরিবারটি। হাসিনার নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলারা তাদের এ সুবিধা নিশ্চিত করে। অর্থ পাচারের পথ সহজ করা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জবাবদিহি এড়াতে এ কৌশল এস.আলম গ্রুপের মালিকগণ গ্রহণ করেন।
গ্রেফতার হননি সেই তিন কর কর্মকর্তা : এস.আলম গ্রুপ দেশের আর্থিক খাতকে ফোকলা করার কাজটি এককভাবে করেনি। সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিলো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন দফতরে থাকা আমলা এবং রাজস্ব কর্মকর্তাদের। এস.আলম শিল্প পরিবারটির সদস্যরা কৌশলে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেও রয়ে গেছেন তাদের অপরাধের সহযোগীরা। তারা স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা কিংবা কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। এর মধ্যে শুধু সাইফুল আলমের দুই পুত্রের ৫শ’ কোটি টাকা বেআইনি বৈধকরণে জড়িত মাঠপর্যায়ের তিন রাজস্ব কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি।
এনবিআর সূত্রটি জানায়, ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতির দায়ে অতিরিক্ত কর কমিশনারসহ ৪ রাজস্ব আয়কর কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে গত ১৭ অক্টোবর পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থমন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যান।
বরখাস্তকৃত রাজস্ব কর্মকর্তারা হলেন, চট্টগ্রামের তৎকালীন কর আপিল অঞ্চলের অতিরিক্ত কর কমিশনার সাইফুল আলম। ঘটনার সময় তিনি কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রামের যুগ্ম কর কমিশনার ছিলেন। কর অঞ্চল-১৪, ঢাকার যুগ্ম কর কমিশনার এ কে এম শামসুজ্জামান। ঘটনার সময় তিনি কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রামের যুগ্ম কর কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। কর অঞ্চল-২, চট্টগ্রামের সহকারী কর কমিশনার মো: আমিনুল ইসলাম। ঘটনার সময় তিনি কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (ইএসিটি) ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়।
একই ঘটনায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয় কর কমিশনার মো: শফিকুল ইসলাম আকন্দকে। ঘটনার সময় তিনি চট্টগ্রাম কর আপিলাত ট্রাইবুন্যাল, ডিভিশন বেঞ্চের সদস্য ছিলেন। বেঞ্চের সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এস.আলম গ্রুপের অবৈধ অর্থ ‘বৈধ’ করায় সহযোগিতাকারী ৪ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে এনবিআর। পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এনবিআর ‘তফসিলভুক্ত অপরাধ’ বিষয়টি পাঠিয়ে দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)এ। এ ছাড়া আশরাফুল আলম, আসাদুল আলম মাহির ও তাদের সহযোগিতাকারী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য সৈয়দ আবু মো: দাউদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট মো: সুলতান মাহমুদ। গত ২৬ সেপ্টেম্বর আবেদনটি করা হয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার খোঁজ নিয়ে জানাযায়, সংস্থাটি এখনো ৪ রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, এস.আলম গ্রুপের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ এবং বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তবে সংস্থাটির মুখপাত্র ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো: আকতার হোসেন বৃহস্পতিবার চার রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে কি না এবং তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে কি না নিশ্চিত করতে পারেন নি।