Image description

রাজনীতির আকাশ থেকে কেটে গেছে কালো মেঘ। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া।

দীর্ঘ ১৭ বছর ভোট দিতে পারেনি বাংলাদেশের জনগণ। তাই এবার অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিতে উন্মুখ গোটা জাতি। জনবান্ধব নির্বাচিত সরকার পেতে আবার ভোট উৎসবে মাতবে জনগণ। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তারেক রহমান আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব দেন। সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি‌র ওপর জোর দিলেও প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের পর আগামী নির্বাচন নিয়ে যে সন্দেহ-সংশয় ছিল তা কেটে গেছে।

তারা বলছেন, ওই বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হওয়ায় দেশজুড়ে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের মধ্যে যে বৈঠক হয়েছে তা খুবই ইতিবাচক। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দেশের জন্য মঙ্গল। শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, নির্বাচন হতে হবে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) শিগগিরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে, লন্ডনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের এ কথা জানানোর পর এখন সবার চোখ কমিশনের দিকে। ইসি সূত্র বলছে, অনানুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কমিশন কার্যালয়ে বসার কথা রয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের।

এদিকে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আগ্রহী প্রার্থীরা। তবে প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে অন্য সব দলের চেয়ে এগিয়ে আছে সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার থাকা জামায়াতে ইসলামী।

তৃণমূলে সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠকসহ নানাভাবে ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ব্যানার, ফেস্টুনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে প্রচার-প্রচারণা।

কেন্দ্রে চলছে জোর প্রস্তুতি
আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে ভেতরে ভেতরে জোরালো প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রার্থী বাছাইয়ের পাশাপাশি নির্বাচনী ছক কষতে শুরু করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো।

নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী কারা হবেন তা নিয়েও বিএনপিসহ অন্যান্য দল কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে খোঁজখবর চালিয়ে যাচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের আমলনামা পর্যালোচনা চলছে। ক্লিন ইমেজ, দলের প্রতি ত্যাগ, স্থানীয় পর্যায়ে জনসমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে জিতে আসার সম্ভাবনা- এসব বিষয়ে চলছে বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা।

গণহত্যার বিচার, সংস্কার এবং জুলাই সনদ ঘোষণাকে গুরুত্বসহকারে অগ্রাধিকার দিলেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে কোনো আপত্তি নেই জামায়াতে ইসলামীর। জামায়াত ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ওই প্রার্থীরা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরেই নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছেন বলে দলটির সূত্রে জানা গেছে।

আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন বিভিন্ন দাবিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আন্দোলন করেছি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন। আর এই নির্বাচনের জন্যই মানুষ অপেক্ষা করছে। নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশব্যাপী উৎসাহ উদ্দীপনা বিরাজ করবে এটাই স্বাভাবিক।

আগামী নির্বাচনের যে দামামা বেজে উঠেছে তা বাস্তবে প্রতিফলিত হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

জাতীয় নির্বাচনের জন্য আগামী ফেব্রুয়ারি মাসই উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকের পর সারা দেশে যে উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে, তাতেই প্রমাণিত হয় মানুষ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কতটা অপেক্ষায় আছে।

নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এ্যানি বলেন, নির্বাচন নিয়ে দুই একটি রাজনৈতিক দল কিছুটা কৌশলী মন্তব্য করছে। তবে অধিকাংশ দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

দেশের মানুষ প্রায় ১৬ বছর অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চেখে দেখেনি উল্লেখ করে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করা বেশ ভালো লক্ষণ। দীর্ঘদিন জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার গণতান্ত্রিক মনোভাব খুব শক্তিশালী না হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন বেশ কঠিন হবে বলে মনে করেন মঞ্জু।

তিনি বলেন, প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই এখনও সংশয়ে আছেন। আমরা আশা করবো, সরকার এ ব্যাপারে খুব সচেষ্ট হবে।

ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে জনগণ মুখিয়ে আছে মন্তব্য করে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ভোট দিতে পারেনি। বিগত ৩টি জাতীয় নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগ এবং ভারত থেকে পূর্ব নির্ধারিত ছিল।

উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ড প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, আশা করি আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং ভারতীয় প্রভাবমুক্ত।

তৃণমূলে বইছে নির্বাচনী হাওয়া
ঈদুল আজহার ছুটিতে এলাকায় প্রাথমিক গণসংযোগ সেরে নিয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ঈদ উদ্‌যাপন করতে নিজ নিজ গ্রামে ফিরেছিলেন কর্মজীবী মানুষ। আর নানাভাবে তাদের কাছে যাওয়া, নজর কাড়ার চেষ্টা করেছেন প্রার্থীরা। এক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামির নেতাদের বেশি সরব দেখা গেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো।

যশোর-৪ নির্বাচনী এলাকার বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব এবং শ্রমিক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফারাজি মতিয়ার রহমান। তারা দুজনেই মনোনয়ন নিশ্চিত করতে কেন্দ্রে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ করছেন।

শনিবার ফরাজি মতিউর রহমান স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে এক ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের আয়োজন করেন। সেখানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তার মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অপরদিকে ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব ঈদ উপলক্ষে নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণের মাঝে ঈদ সামগ্রী বিতরণ করেন। বিভিন্ন বাজারে গণসংযোগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন এই আসনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা এবং নেতাকর্মীদের হামলা মামলায় তাদের পাশে দাঁড়ান।

শুধু যশোর-৪ আসনেই নয়, সারা দেশে চলছে নির্বাচনমুখী তৎপরতা। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতীক পাওয়ার আগে মাঠ গোছানোর কাজ করছেন আগ্রহী প্রার্থীরা। ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে উৎসব মুখর পরিবেশে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মাহবুবুর রহমান মুন্না জানান, কয়রা-পাইকগাছা উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৬ আসন। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করলেও জামায়াত খুলনা-৬ আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ঈদের ছুটিতে গ্রামে-গঞ্জে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন। ঈদ শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন তারা।

প্রার্থীদের একজন জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও সিনিয়র সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম কাগজি। তিনি ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়াও উপকূলীয় উপজেলা কয়রা ও পাইকগাছায় বেশ কয়েকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের পরিচালক আমিরুল ইসলাম কাগজি বাংলানিউজকে বলেন, বিগত আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ১৬ বছর আন্দোলন সংগ্রাম করেছি পেশাজীবী নেতা হিসেবে সাংবাদিকদের নিয়ে রাজপথে থেকেছি।

খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান। আগামী নির্বাচনেও ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়ন পেতে এলাকায় তৎপর তিনি। আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে একই আসনে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা জিয়াউর রহমান পাপুল।