
এক সময় যিনি সন্তানকে হাত ধরে হাটতে শিখিয়েছেন, কাঁধে তুলে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়েছেন, আজ বয়সের ভারে নুয়ে পড়া সেই বাবা হয়তো নিজের ছেলের ঘরেই ‘অযাচিত বোঝা’। মা, যিনি নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন, সেই মা-ই হয়তো আজ পড়েছেন অবহেলার চাদরে ঢাকা পড়া একাকী জীবনে।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বাড়ছে প্রবীণদের প্রতি নির্যাতন। অথচ এই মানুষগুলোই একদিন ছিলেন সমাজ ও পরিবারের মূল চালিকাশক্তি।
বাংলাদেশে প্রবীণ নির্যাতন
প্রবীণ নির্যাতন মানেই শুধু মারধর নয়। এর চেয়েও ভয়ংকর হলো মানসিক অবহেলা, অবজ্ঞা, অবরুদ্ধ করা, আর্থিক ঠকানো কিংবা প্রয়োজনের সময় পাশে না থাকা।
অনেকে সারাদিন অন্ধকার ঘরে বসে থাকেন, এক কাপ চা বা একটিবার কথা বলার জন্য কাউকে পান না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতি ৬ জন প্রবীণের একজন এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। অথচ সমাজের চোখে এগুলো যেন ‘স্বাভাবিক’ আচরণ।
হেলপএজ ইন্টারন্যাশনাল-এর ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৮৮ শতাংশ প্রবীণ মানসিক নির্যাতনের, ৮৩ শতাংশ অবহেলার, ৫৪ শতাংশ আর্থিক নির্যাতনের এবং ৪০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
নির্যাতনের রূপ কীভাবে প্রকাশ পায়?
অনেক প্রবীণকে সন্তানদের হাতে আর্থিক প্রতারণার শিকার হতে দেখা যায়। কেউ পেনশনের টাকা কেড়ে নেয়, আবার কেউ জমি লিখে নেওয়ার পর বৃদ্ধ বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আবার অনেকেই মুখ ফুটে কিছু বলেন না-কারণ তারা পরিবার ভাঙতে চান না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ নারী বলেন, ‘আমার ছেলে বউ দু'জনেই চাকরি করে। সারাদিন বাসায় একা থাকি। কেউ একটিবার জিজ্ঞেসও করে না, খেয়েছি কি না। বাসায় আসলেও তেমন একটা সময় দেয় না। আমার এখন টাকা-পয়সার দরকার না, দরকার একটু সময়ের।’
এটা একক কোনো ঘটনা নয়, বরং সমাজজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেক প্রবীণের নীরব ব্যথা।
সমাজের দায় কী?
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রবীণদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব গড়ে তুলতে না পারলে ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘প্রবীণ নির্যাতন এখন আর ঘরোয়া বিষয় নয়। এটা একটি বড় সামাজিক সংকট। আমাদের সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বা স্কিম হাতে নিচ্ছে যেমন, পতিতা পুনর্বাসন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছি একদম তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ততদিন আমাদের এসব স্কিম একদম কোনো কাজে আসবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবীণ নির্যাতন, নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ চর্চা করতে হবে। কিন্তু দেখা যায় আমাদের দেশে এ চর্চাটাতো নেই। ফলে নারী নির্যাতন হবে, শিশু নির্যাতন হবে, প্রবীণ নির্যাতন হবে।’ তার মতে, সামাজিক মূল্যবোধ, সচেতনতা, আইনি সহায়তা, এবং প্রবীণবান্ধব নীতিমালাই পারে এই সংকট কমাতে।
প্রবীণদের প্রথম আশ্রয় পরিবার
যে পরিবার একসময় প্রবীণদের আশ্রয় দেয়, সেই পরিবারেই যখন নির্যাতনের জন্ম হয়, তখন প্রশ্ন উঠে মানবতার মৌলিকত্ব নিয়ে। তাই প্রতিটি পরিবারে দরকার সচেতনতা, মূল্যবোধের শিক্ষা।
সমাজকর্মী সিজুল ইসলাম বলেন,‘সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ ও সহানুভূতি শেখাতে হবে। বাবা-মায়ের চাহিদা শুধু আর্থিক নয়, মানসিক ভালোবাসাও জরুরি। তাই এ বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।’
একটি পরিবারের ছোট একটি শিশুও যেন দেখে-তার দাদি বা নানিকে সবাই কেমন ভালোবাসে, খোঁজ নেয়। এভাবেই গড়ে উঠবে ভবিষ্যতের সহানুভূতিশীল প্রজন্ম। আর কমে আসবে প্রবীণ নির্যাতন।
প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধে কী করা যায়?
১. সচেতনতা তৈরি: গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে প্রবীণদের অধিকার নিয়ে বেশি বেশি প্রচারণা চালাতে হবে।
২. আইনি সুরক্ষা: প্রবীণদের জন্য একটি শক্তিশালী ও কার্যকর আইন থাকা জরুরি, যেখানে নির্যাতনের শিকার হলে তারা সহজে অভিযোগ করতে পারেন।
৩. প্রবীণ সহায়তা কেন্দ্র: প্রতিটি উপজেলায় প্রবীণদের জন্য হেল্পলাইন, কাউন্সেলিং সেন্টার ও চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সম্পর্ক উন্নয়ন: বাবা-মায়ের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, সময় দেওয়া এই ছোট ছোট কাজই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
মনে রাখতে হবে, প্রবীণরা আমাদের অতীত। তারাই আমাদের এই পৃথিবীতে এনেছেন, গড়ে তুলেছেন, দাঁড় করিয়েছেন। আজ যদি আমরা তাদের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে আমাদের আগামীটা কেমন হবে? যে সমাজ তার প্রবীণদের শ্রদ্ধা করতে পারে না, সে সমাজ সভ্য নয়-শুধু বসবাসের জায়গা।
তাই আসুন, প্রবীণদের বিরুদ্ধে নয় তাদের জন্য দাঁড়াই। তাদের চোখে হাসি ফোটাই, যেন আমাদের ভবিষ্যতেও কেউ একা না থাকে।