Image description

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাপ্লাই কোম্পানির ফাঁদ থেকে বের হতে পারছেন না প্রবাসী শ্রমিকরা। অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে গেলেও পাচ্ছেন না প্রতিশ্রুত কাজ। কাজ পেলেও ঠিকমতো বেতন বা মজুরি পান না। নিম্নমানের বাসস্থান থেকে কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে কাজ করতে হয় তাদের। ইকামা (বসবাসের অনুমতি) নবায়ন করতে না পেরে পাসপোর্ট জব্দের মতো ঘটনাও ঘটছে। নানান ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে স্বপ্নের প্রবাস দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিচ্ছে।

সাপ্লাই ভিসা কী?

সাপ্লাই ভিসা হলো এমন একটি ভিসা যা কোনো ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির কাজ করার জন্য ইস্যু করা হয় না, বরং একজন মধ্যস্থতাকারী কোম্পানির মাধ্যমে অন্য কোম্পানিতে কাজ করার জন্য ইস্যু করা হয়। এই ধরনের ভিসায় মধ্যস্থতাকারী কোম্পানিকে ‘সাপ্লাই কোম্পানি’ বলা হয়। তারা প্রবাসী শ্রমিকদের তাদের গ্রাহক কোম্পানিতে কাজ করার জন্য সরবরাহ করে।

সাপ্লাই ভিসার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো: প্রবাসী শ্রমিকের ভিসায় সাপ্লাই কোম্পানির নাম উল্লেখ থাকে, কিন্তু গ্রাহক কোম্পানির নাম উল্লেখ থাকে না। ভিসায় কাজের ধরন ও বেতন উল্লেখ থাকে না। থাকার ও কাজের অনুমতি একই কোম্পানি থেকে ইস্যু করা হয় না।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ভিসা বিক্রির সময় সাপ্লাই কোম্পানির কথা উল্লেখ থাকে না। নির্দিষ্ট কোম্পানি কিংবা চাহিদা অনুযায়ী কাজের প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বিদেশ গেলে সেখানে প্রতিশ্রুত কাজ পাওয়া যায় না। কোম্পানির ইচ্ছা অনুযায়ী সাধ্যের বাইরে কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে হয়। কাজ করলেও নেই বেতন। মাসের মধ্যে দুই থেকে তিনবার কাজ পরিবর্তন করতে হয়। ঠিকমতো হয় না ইকামা। ফলে অবৈধ হচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক।

‘কোম্পানির কাজের কথা বলে এখানে এসে আর সেই কোম্পানি পাইনি। দেড় বছরে রাজমিস্ত্রি থেকে শুরু করে ক্লিনারসহ নানান জায়গায় কাজ করিয়েছে। অনেক গাধার খাটুনি ছিল, তবু করেছি। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাকে বলছে, দোকানের ভিসা। এরপর ইকামাও করে দেয়নি। অবৈধ ছিলাম এক বছর।’- সৌদি প্রবাসী গোলাম মোস্তফা

বেকারত্ব ঘোচাতে ২০২৩ সালে কাজের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যান লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা। সৌদি আরবে সুপারশপে কাজ দেবে বলে নেওয়া হলেও গিয়ে সাপ্লাই কোম্পানির ফাঁদে পড়েন। টানা দেড় বছরে ছয় থেকে সাত বার তার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন হয়। সর্বশেষ অবৈধ হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন তিনি।

গোলাম মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোম্পানির কাজের কথা বলে এখানে এসে আর সেই কোম্পানি পাইনি। দেড় বছরে রাজমিস্ত্রি থেকে শুরু করে ক্লিনারসহ নানান জায়গায় কাজ করিয়েছে। অনেক গাধার খাটুনি ছিল, তবু করেছি। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমাকে বলছে, দোকানের ভিসা। এরপর ইকামাও করে দেয়নি। অবৈধ ছিলাম এক বছর। একপর্যায়ে পুলিশ আমিসহ বহু মানুষকে ধরে জেদ্দায় মরুভূমিতে ছেড়ে দেয়। পরে বিভিন্ন জায়গায় কল দিয়ে এখন এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি। এখন হয়তো দেশে ফেরত যেতে হবে। লুকিয়ে অবৈধ হয়ে কাজ করা যায় না। যে দালালের মাধ্যমে আসছি, সে ফোন বন্ধ করে দিছে। কষ্টের শেষ নেই।’

সাপ্লাই কোম্পানিতে যেভাবে প্রতারিত হন প্রবাসী কর্মীরা

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থাকা একাধিক সূত্র জাগো নিউজকে জানিয়েছে, বাংলাদেশের অসাধু কয়েকজন মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকদের সাহায্যে সাপ্লাই কোম্পানি খোলেন। এরপর জনবল সরবরাহের জন্য সেখানকার বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেন। এভাবে তারা ৩০০-৪০০টি ভিসা বের করে। এরপর এসব ভিসায় বাংলাদেশ থেকে মিথ্যা প্রলোভনে কর্মী আনা হয়। কর্মী আনলেও তারা চুক্তি অনুযায়ী কাজ দিতে পারে না। কাজ দিলেও কর্মীদের বেতন সাপ্লাই কোম্পানির মাধ্যমে নিতে হয়। ফলে মূল বেতন থেকে অনেক অর্থ কেটে রাখে ভিসা ইস্যু করা সাপ্লাই কোম্পানিগুলো।

‘আমি এসে দেখি লজিস্টিক সাপ্লাই কোম্পানি। তিন মাস আমাকে বসিয়ে রেখেছে। কোনো কাজ কিংবা বেতন আমাদের দেয়নি। আমি অনেক টাকা ঋণ করে এসেছি। ঋণের ভার নিয়ে বেকার ছিলাম এতদিন। এভাবে আছি, আমরা ১৬ জন। মে মাসে এসে এয়ারপোর্টে কাজ দিছে, তাও শুধু ১৫ দিন কাজ।’- সৌদি প্রবাসী সোহেল রানা

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি আরবে যান চাঁদপুর জেলার সোহেল রানা। তাকে সৌদির বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নুর কোম্পানিতে কাজ দেবে বলে নেওয়া হয়। সৌদি গিয়ে তিনি দেখেন তাকে সাপ্লাই কোম্পানির ভিসা দেওয়া হয়েছে।

সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এসে দেখি লজিস্টিক সাপ্লাই কোম্পানি। তিন মাস আমাকে বসিয়ে রেখেছে। কোনো কাজ কিংবা বেতন আমাদের দেয়নি। আমি অনেক টাকা ঋণ করে এসেছি। ঋণের ভার নিয়ে বেকার ছিলাম এতদিন। এভাবে আছি, আমরা ১৬ জন। মে মাসে এসে এয়ারপোর্টে কাজ দিছে, তাও শুধু ১৫ দিন কাজ। এরপর অন্য কোথাও নিয়ে যাবে। স্যালারি দেবে কি না তারও ঠিক নেই। এখন এখানে অনিশ্চিত অবস্থা, একেক মাসে একেক জায়গায় কাজ দেবে। তিন মাসে ইকামার মেয়াদ শেষ। নতুন করে ইকামা না করে দিলে অবৈধ হয়ে যাব।’

সাপ্লাই কোম্পানির বর্ণনা দিয়ে সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি যে কোম্পানিতে আছি, এখানে দুই বাংলাদেশি মিলে সৌদি নাগরিকের মাধ্যমে লাইসেন্স করে ভিসা বের করে আমাদের আনছে। অথচ দেশে এদের প্রতিনিধিরা বলছে, বড় কোম্পানি। এখানে এসে তো আমরা প্রতারিত। কোনো কূল পাচ্ছি না। সত্যি বলতে সৌদি আরবের কোনো সাপ্লাই কোম্পানিই ভালো না।’

দালালদের পরিচয় জানতে চাইলে কর্মক্ষেত্রে সমস্যা হবে বিধায় তিনি এই প্রতিবেদককে পরিচয় জানাননি।

‘আমাদের দেশের দালাল আর অসাধু ব্যবসায়ীরা এজন্য দায়ী। এরা এ দেশের কফিলকে টাকা দিয়ে বলে, ৫০টা লোক এনে আপনাদের দিব। আপনি ভিসা দেন। এরপর এসব ভিসায় লোক এনে আর কাজ দিতে পারে না। অবৈধ হয়ে ছোটাছুটি করে।’ –সৌদি আরবের ব্যবসায়ী টিপু সুলতান

সৌদি আরবে ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করছেন গোপালগঞ্জের টিপু সুলতান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এই দেশে লাখ লাখ কর্মী সাপ্লাই কোম্পানির ফাঁদে পড়ে ভোগান্তিতে আছেন। মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমাদের দেশের দালাল আর অসাধু ব্যবসায়ীরা এজন্য দায়ী। এরা এ দেশের কফিলকে টাকা দিয়ে বলে, ৫০টা লোক এনে আপনাদের দিব। আপনি ভিসা দেন। এরপর এসব ভিসায় লোক এনে আর কাজ দিতে পারে না। অবৈধ হয়ে ছোটাছুটি করে। একটা সময় কাজ বেশি ছিল, মানুষ কম ছিল। তখন সাপ্লাই কোম্পানিতে গেলেও মানুষ কাজ পেত কিন্তু এখন হাজার হাজার মানুষ।’

‘আমাদের দেশের মানুষেরও দোষ আছে, অনেকে জেনে শুনে আসে। তারা বলে আত্মীয় আছে, কাজের এক ব্যবস্থা হবে। এমন আশ্বাস নিয়েই তারা এখানে কষ্টে দিন পার করেন’ যোগ করেন টিপু সুলতান।

সাপ্লাই কোম্পানির দৌরাত্ম্য কাতারেও

ভাগ্য বদলের আশায় ২০২১ সালে কাতার যান নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার হাশেম খান (ছদ্মনাম)। টানা তিন বছর সাপ্লাই কোম্পানিতে নানান বঞ্চনার শিকার হন তিনি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমাকে নিয়ে মার্কেটে ক্লিনারের কাজ দিয়েছে। কথা ছিল আট থেকে নয় ঘণ্টা ডিউটি। কিন্তু ওখানে নিয়ে কাজ করিয়েছে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা করে। মাসে ছুটি পেতাম একদিন। অথচ দেশে থাকতে বলা হয়েছিল, সপ্তাহে ছুটি একদিন। বেতন ১২শ রিয়াল দেওয়ার কথা থাকলেও দিত ৮০০ থেকে ৯০০ রিয়াল। ইকামা ও ছুটি নিয়েও গড়িমসি করতো। ঈদের দিনও কাজ করাতো। সাপ্লাই কোম্পানি যেভাবে পারছে সেভাবে আমাদের ইউজ করছে। একপর্যায়ে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এক আত্মীয়র মাধ্যমে একটা কোম্পানিতে চাকরি নেই। সেখানে ইকামার ব্যবস্থা করে দেয়।’

‘সৌদি আরবের এ সমস্যা সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমি যখন সৌদিতে ছিলাম, বহু কোম্পানি ভিজিট দিয়ে দেশে জানিয়েছি এসব কোম্পানির স্যালারি ও ইকামা হবে না, ম্যানপাওয়ার যেন না দেয়। কিন্তু আমাদের এজেন্সিগুলো সেটা মানে না। তারা এসে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘেরাও দেয়। তখন আর আমাদের হাতে কিছু করার থাকে না। এজেন্সি আর দালালরা এভাবে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে আসছে।’ - পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক মোস্তফা জামিল খান

প্রতারণায় নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরত

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে ৮০ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫০ জন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশ গেছেন। সরকারি এ সংস্থার কাছে বিদেশগামীদের সংখ্যা থাকলেও কতজন ফিরে আসছেন, তার কোনো তথ্য নেই।

তবে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্যমতে, এ ১০ বছর বিভিন্ন দেশে অবৈধ হয়ে আউটপাস নিয়ে ছয় লাখ ৭৩ হাজার ৫৭০ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। বৈধ পথে বিদেশ গিয়ে অবৈধ হয়ে ফিরে আসাদের এ সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ সাপ্লাই কোম্পানি ও ফ্রি ভিসায় গিয়ে অবৈধ হয়ে দেশে ফেরত আসছেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৪৫ হাজার ৯৮৪ জন বাংলাদেশি অবৈধ হয়ে বিদেশ থেকে শূন্য হাতে ফিরেছেন। ২০২১ সালে আউটপাস নিয়ে দেশে ফিরে আসেন ৭২ হাজার ৬০৯ জন কর্মী। ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ৯৭ হাজার ৯১৩। ২০২৩ সালে ৮৬ হাজার ৬২১ ও ২০২৪ সালে ৮৮ হাজার ৮৬৮ জন বৈধ অভিবাসী শ্রমিক অবৈধ হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।

এদিকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর লোকজন বলছেন, অসাধু লোকদের কারসাজিতে এমন হচ্ছে। পাশাপাশি বিএমইটিও দায়ী। আমাদের দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলো বিদেশে কোম্পানিরগুলোর ভিসা যাচাই-বাছাই না করেই কাজের অনুমতি দেয়। এখানেই প্রতারকরা সুযোগ নেয়। একটা কোম্পানি যখন ১০০ লোক নেবে তখন দূতাবাসের খোঁজ করা উচিত, সেখানে সেই সংখ্যক লোকের কাজ আসলে আছে কি না। কোম্পানির অস্তিত্ব আছে কি না, বেতন দেবে কি না এটাও খোঁজ নেওয়া উচিত।

রিয়াজ ওভারসিজের স্বত্বাধিকারী ও রিক্রুটিং এজেন্সিদের সংগঠন বায়রার সাবেক সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে এই সমস্যাগুলো সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে। আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিদেশে সৌদি কোম্পানির সঙ্গে লিয়াজোঁ করে লোক সাপ্লাই দেয় আর শ্রমিকদের হয়রানি করে। এসব কোম্পানি খুবই নিম্নমানের। এদের অধিকাংশ দিন আনে দিন খায়। দেশের বহু এজেন্সি বিজ্ঞাপন দেয় বড় কোম্পানির নামে। পরে বিদেশে নেওয়ার পর ইকামা দেয় না, কর্মহীন অবস্থায় রাখে দুই-তিন মাস। এসব ভিসা নিয়ে তদন্ত করতে হবে, আসলে কর্মী গেলে কাজ পাবে কি না। অথবা দূতাবাস বা হাইকমিশনকে এ বিষয়ে নজরদারি রাখতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক মোস্তফা জামিল খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সৌদি আরবের এ সমস্যা সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমি যখন সৌদিতে ছিলাম, বহু কোম্পানি ভিজিট দিয়ে দেশে জানিয়েছি এসব কোম্পানির স্যালারি ও ইকামা হবে না যেন ম্যানপাওয়ার না দেয়। কিন্তু আমাদের এজেন্সিগুলো সেটা মানে না। তারা এসে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘেরাও দেয়। তখন আর আমাদের হাতে কিছু করার থাকে না। এজেন্সি আর দালালরা এভাবে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে আসছে। সৌদিতে প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশি আছে। এই শ্রমবাজারে মনে হয় না আর লোক পাঠানো উচিত হবে। বহু বাঙালি গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন। আমরা সৌদি যাওয়ার হিসাব রাখি, কিন্তু প্রতি মাসে কত শ্রমিক নিঃস্ব হয়ে ফেরত আসেন সেই খবর রাখি না।’

‘সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে এই বাজারটিতে সংকট তৈরি হবে। সরকার যদি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা না করে তাহলে বিপর্যয় বাড়বে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের দেখে শুনে যেতে হবে।’ -অভিবাসন বিশ্লেষক আসিফ মুনীর

শ্রমিকরা সচেতন না হলে প্রতারণা বাড়বে

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই ফ্রি ভিসা, সাপ্লাই কোম্পানিসহ নানান জটিলতা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক যাচ্ছেন সৌদিতে। যাদের অধিকাংশই কর্মহীন হয়ে থাকছেন কিংবা দেশে ফিরছেন।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে দুই লাখ ৩০ হাজার ২৫৫ জন শ্রমিক শুধু সৌদি আরবে গেছেন। একই সময় কাতারে গেছেন ২৯ হাজার ৩৯১ জন, কুয়েত আট হাজার ৮২৭ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক হাজার ৭৬২ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি আরবের শ্রমবাজার স্থিতিশীল হলেও অস্থিতিশীলতা এখানে বেশি, ভোগান্তিও চরমে।

অভিবাসন বিশ্লেষক আসিফ মুনীর জাগো নিউজকে বলেন, সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে এই বাজারটিতে সংকট তৈরি হবে। সরকার যদি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা না করে তাহলে বিপর্যয় বাড়বে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের দেখে শুনে যেতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া অনুবিভাগের পরিচালক মোস্তফা ফয়সাল জামিল বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকটের একটি বড় কারণ হলো আমাদের কর্মীদের অদক্ষতা। তারা সচেতন হচ্ছেন না। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এরাও এজেন্সিগুলোর সঙ্গে এসে আন্দোলন করেন। পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য ওঠে পড়ে লাগেন। অথচ এরাই তিন মাস, ছয় মাস পরে দেশে চলে আসেন। হাজার হাজার মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের জেলে বন্দি। তাই শ্রমিকদের বুঝতে হবে, তারা কোথায় যাচ্ছেন, কার কাছে যাচ্ছেন। এটা খুবই জরুরি।’

‘আমি মনে করি এসব সাপ্লাই কোম্পানি পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে। এরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ দেয় না, কর্মীর কোনো দায়িত্ব নেয় না। এটা সবচেয়ে বড় সংকট। আবার কোম্পানি দু-তিন মাসের মধ্যে হঠাৎ করে কর্মীদের জানিয়ে দেয়, কাজ শেষ।’ -অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম

অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশে এসব সাপ্লাই কোম্পানি হাজার হাজার। যাদের ৯০ শতাংশ শ্রমিকদের শোষণ কিংবা জিম্মি করে কাজ করাচ্ছে। বিশেষ করে সৌদিতে বহু কোম্পানি শ্রমিকদের ইকামা করে দেয় না। ফলে কর্মীরা তিন মাস, ছয় মাস, আট মাসের মাথায় কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কিংবা অবৈধ হয়ে দেশে ফেরত আসছেন। তাই এসব প্রতারক এজেন্সির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিদেশে দূতাবাসগুলো কঠোর নজরদারি করতে হবে।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি এসব সাপ্লাই কোম্পানি পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে। এরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ দেয় না, কর্মীর কোনো দায়িত্ব নেয় না। এটা সবচেয়ে বড় সংকট। আবার কোম্পানি দু-তিন মাসের মধ্যে হঠাৎ করে কর্মীদের জানিয়ে দেয়, কাজ শেষ। এর মধ্যে বহু কর্মী অবৈধ থাকে, কাজ পায় না, নির্মম কষ্ট ভোগ করে। দু-তিন মাস পর অনেক কোম্পানির অস্তিত্বও পাওয়া যায় না। হাতেগোনা কিছু কোম্পানি শ্রমিকদের ঠিকমতো কাজ ও স্যালারি দেয়।’

শাকিরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন দেশে বিমানবন্দরে অনেক কর্মীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা একই অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন না, নির্মম কষ্ট সহ্য করে টিকে আছেন। অথচ সাপ্লাইয়াররা কিন্তু মেইন কোম্পানি থেকে ঠিকই পরিপূর্ণ বেতন নিচ্ছে।

‘২০ বছর ধরে এ সেক্টরে আছি। কখনো কঠোরমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি এসব দালাল ও এজেন্সির বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এদের বিচারের আওতায় আনা হয় না। আবার ভুক্তভোগী কর্মীরা মামলা কিংবা অভিযোগ করলেও তাদের নানান হুমকি দেওয়া হয়। তাই অভিযুক্ত এজেন্সির পানিশমেন্ট খুবই জরুরি।’ বলেন শাকিরুল ইসলাম।