
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনটি গোপন বন্দিশালা ঘুরে দেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তখন আলোচনায় আসে একটি বৈদ্যুতিক চেয়ার, যা মোটরের সাহায্যে ঘোরানো যায়। সম্প্রতি সরকারের কাছে জমা দেওয়া গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদনে এই ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের জবানবন্দি ও কমিশনের অনুসন্ধানে দুই ধরনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেগুলোতে বেঁধে দ্রুতগতিতে ঘোরানোর ফলে ভুক্তভোগী বমি, প্রস্রাব, মলত্যাগের পাশাপাশি অচেতন হয়ে যেত।
গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কাছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, কমিশন মোট ১৮৩৭টি গুম সংক্রান্ত অভিযোগ পেয়েছে। প্রাথমিক পর্যালোচনার পর এর মধ্যে ১৭৭২টি অভিযোগ কমিশনের ডাটাবেজে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে ১৪২৭ জন ভুক্তভোগী জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছেন এবং এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৩৪৫ জন।
কমিশনের তথ্য মতে, এসব গুমের ঘটনায় নির্দিষ্ট কিছু আইন প্রয়োগকারী ও নিরাপত্তা সংস্থার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গুমের অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো জড়িত। বিশেষ করে পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)— এদেরই দায়ভার সবচেয়ে বেশি, মোট ঘটনার ৬৭ ভাগের বেশি তারা ঘটিয়েছে।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ব্যবহার করে নির্যাতনের বর্ণনা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। কমিশন জানিয়েছে, ভুক্তভোগীদের বর্ণনা, সরেজমিন পরিদর্শন ও কমিশনের অনুসন্ধানে দুই ধরনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ব্যবহার করে নির্যাতনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর একটি ব্যবহার করত র্যাব, যা চেয়ারের মতো। এই ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে বন্দিশালায় আটকে রাখা ভুক্তভোগীকে প্রচণ্ড গতিতে ঘোরানো হতো। এতে বমি, প্রস্রাব, মলত্যাগ করার পাশাপাশি অচেতন হয়ে যেত ভুক্তভোগীরা। চেয়ারের মতো দেখতে এই যন্ত্রটি টিএফআই সেলে এবং র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে পাওয়া গেছে। একজন সৈনিকের বরাতে কমিশন জানিয়েছে, টিএফআইতে থাকা চেয়ারসদৃশ যন্ত্রটি প্লাস্টিক শিট দিয়ে ঢেকে তার ওপর নির্ধারিত ব্যক্তিকে বসানো হতো, যাতে ভুক্তভোগীর শরীর থেকে বেরিয়ে আসা বর্জ্য দ্রুত পরিষ্কার করা যায়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধরনের যন্ত্রটি পাওয়া গেছে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি), যা ঠিক চেয়ার নয়, তবে পুরো শরীর বেঁধে ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘোরানো যেত। নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চোখ সাধারণত বাঁধা থাকায় যন্ত্রটির গঠন ঠিক বোঝা কঠিন। তবে ভুক্তভোগীদের কীভাবে বেঁধে রাখা হয়েছিল, যন্ত্রটি কীভাবে ও কোন দিকে ঘুরত, তারা কী ধরনের শব্দ পেতেন—সেগুলোসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর তথ্য পেয়েছে কমিশন। এসব গোপন বন্দিশালায় কর্মরত স্টাফদের সাক্ষ্যেও এসব বর্ণনার মিল পাওয়া গেছে। জেআইসিতে ব্যবহৃত যন্ত্রটি সম্পর্কে একজন ভুক্তভোগী বলেন, যন্ত্রটিতে তাকে যেভাবে ঘোরানো হতো, তা যেন ‘ঘড়ির কাঁটার মতো’।
কমিশনের প্রতিবেদনে একজন ভুক্তভোগীর বয়ান তুলে ধরা হয়। ওই ভুক্তভোগী বলেন, ‘যখন জিজ্ঞাসাবাদ করত, তখন চোখ বাঁধা থাকত তিনটি কাপড় দিয়ে। প্রথমে একটা কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধত। জমটুপি পরানোর পরে আবার আরেকটা কাপড় দিয়ে বাঁধত। আর হ্যান্ডকাফ পেছনে লাগানো থাকত। চেয়ারটাতে বেঁধে, আমার দুই হাঁটু পিটিয়ে একেবারে ফাটিয়ে ফেলে। প্রায় ১০-১৫ দিন আমি সোজা হয়ে হাঁটতে পারতাম না। হাঁটার তো সুযোগ ছিল না। দাঁড়াইয়া যে নামাজ পড়ব, সে সুযোগও ছিল না। পা ঝুলিয়ে, মানে ভিন্ন পাশে পা ঝুলিয়ে দিয়ে তারপর নামাজ পড়তে হতো। স্বাভাবিক একটা চেয়ার। হুইলচেয়ারে যেমন পা রাখা যায়, ওরকম পাদানি আছে। পাদানির ওপরে পা রাখার পরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত অনেক বেল্ট লাগায়। মাথায় লাগায়, তারপরে বুকে, হাতের এদিকেও লাগায়। দুই সাইডে হাতে লাগায় তিনটা, বুকে লাগায় দুটি, পেটে একটা, বুকে একটা বড় বেল্ট, মাথা, পায়ে এরকম তিনটা। এগুলোর পর আমাকে কিছুক্ষণ ঘোরানো হয়। এভাবে ওই চেয়ারে ঘোরানো হয়েছে।’
দ্বিতীয় ধরনের যন্ত্রের তথ্য উঠে আসে আরেক ভুক্তভোগীর জবানবন্দিতে। তিনি কমিশনকে বলেন, ‘একটা মেশিনে উঠাইছিল। উঠাই এইখানে [মাথায়] বাঁধছে, এইখানে [হাতে] বাঁধছে, পায়ে বাঁধছে, মানে হাঁটুর মিডলে, এইখানে আবার পায়ের নিচেও বাঁধছে। এরকম সোজা দাঁড়ানো। ওই মেশিনটায় উঠায় চালানোর পরে মনে হইছে যে, আমার হাড় সম্পূর্ণ যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ওটার সেটিং এরকম যে, মেশিনটাই একটা আজাব। এখানে উঠলে কিন্তু সবাই পায়খানা করে দেয়। মানে এমন কঠিন অবস্থা ওইখানে। মেশিনটা ঘোরানো যায়। কখনো কখনো উল্টা করানো যায়। আবার এরকম ফ্ল্যাট শোয়ানো যায়।’